শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০১৪

রোদ নদী পাহাড় আর লামাদের কাছে

13.JPG
১৭০০ সালে তিব্বতি আগ্রাসন ঠেকাতে বানানো ভুটানি ’জং’।
৮ ডিসেম্বর ২০১০, তাশি নামগায়
ভুটানের পারো শহরে একটি রিসোর্টের রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর আমার মা। রিসোর্টের নাম ‘তাশি নামগায়’। লক্ষ করছি এই রিসোর্টে যারা আমাদের সাথে সকালের নাস্তা করছে তাদের কারো মধ্যেই তাড়াহুড়া নেই। কয়েকটি ওয়েইটার ছেলেমেয়ে এদিক-ওদিক খাবার আনা-নেয়া করছে। তাদের হাঁটাচলা ও কথা বলার ধরনে কোথাও আতিশয্য নেই।
bigri_huye_ghar1.JPG…….
ভেঙে যাওয়া পুরানো ডিজাইনের একটি বাড়ির সামনে লেখক।
…….
এক ধরনের ধীরস্থির ভাব, যেন কোনো কিছুই তাদের উত্তেজিত করে না। যেন খাবার আসতে একটু দেরি করলে কী আর হবে? চোখে ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা আছে। কথা বলার ভঙ্গিতে তোষামোদি নেই, হাসির ছটা। ১৯৭২ সালে জিগমে সিনগে ওয়াংচুক কি এই কারণে “সামগ্রিক সুখ সূচক” বা “গ্রস হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স” ধারণার প্রবর্তন করে গিয়েছিলেন?
—————————————————————–
চ্যানেল বদলাতে বদলাতে দেখি একটা ভুটানি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে বাথরুমে বসে কাঁদছে। কান্নার অভিনয়টা খুব বাস্তব মনে হচ্ছে। আমার মা বলে, “পৃথিবীতে সব দেশেই দেখি মেয়ে মানুষ কান্দে।” মায়ের মন্তব্য শুনে আমি হাসলাম।
—————————————————————-
এই কারণেই কি রাজা পৃথিবীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে একটি দেশের উন্নয়ন বিচার করা উচিত সেই দেশের মানুষের সুখশান্তি দিয়ে, আর্থিক সম্পদ দিয়ে নয়? যখনই ভাবছি একথা দেখি একজন সাদা চামড়ার মহিলা হন্তদন্ত হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলেন। হাতে ল্যাপটপটা খুব উত্তেজিত হয়ে রেখে নাস্তা খোঁজা শুরু করলেন। তিনি নাস্তা প্লেটে নিচ্ছেন আর তার সঙ্গী আরেক মহিলাকে বলছেন রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। উনাদের কাজ বিষয়ে দুই একটা কথা কানে আসতেই নিশ্চিত হলাম উনি কোনো উন্নয়ন গবেষক। আমার মনে হল এই মহিলা ভুটানিদের জীবন নিয়ে ভুটানিদের চাইতে বেশি চিন্তিত। তা না হলে সবাই এত শান্ত, এই মহিলা কেন এত অশান্ত?
রেস্টুরেন্টের সামনে খোলা জায়গায় রোদ দেখা যাচ্ছে। আমি আর আমার মা সকালের নাস্তা সেরে কফি হাতে খোলা জায়গায় গিয়ে বসলাম। রিসোর্টের পাশ দিয়েই একটা নদী গেছে। আর ওই পাড়ে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। নদীর নাম জানা নেই। পাহাড়ের নামও জানা নেই। তবে মাসের নাম যে ডিসেম্বর সেটা না জানলেও জানতে হবে কারণ কনকনে ঠাণ্ডা সারাক্ষণই মনে করিয়ে দেবে “এটা ডিসেম্বর মাস!” গতকাল এসে পৌঁছেছি আমরা। গতকাল কোথাও যাইনি। আজকে সকালেই আমরা বের হব থিম্পুর উদ্দ্যেশে। কিন্তু এই রোদ, এই পাহাড়, এই নদী ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না। আমি আর আমার মা ঠিক করে এসেছি আমরা আমাদের যা ইচ্ছা করে করবো। আমাদের তাই কোনো তাড়াহুড়া নেই। বসলাম ততক্ষণ যতক্ষণ না একজন ওয়েইটার এসে বলল “ড্রাইভার আগিয়া।”
নিচে গিয়ে দেখি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে একটা ছোট নীল গাড়ি আর তার ড্রাইভার। ড্রাইভারের নাম সোনেম, ৬ ফুট লম্বা, পরনে ছাই রঙের ভুটানি পোশাক। সোনেমকে দেখে মনে হল সে আমাদের দেখে খুশি হয়েছে। আমরাও সোনেমকে দেখে খুশি হলাম। আমাকে আর মাকে আন্তরিকতার সাথে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে গাড়িতে উঠতে বলল সোনেম। শুরু হল আমাদের যাত্রা পাহাড়ি রাস্তায়। আমাদের গাড়ি চলতে শুরু করলো থিম্পুর উদ্দ্যেশে। পাহাড়ি পথ, চিকন একটা নদী সুতার মত পাহাড়গুলিকে যেন এক সাথে বেঁধে রেখেছে।
আজকের দিনটা উজ্জ্বল। পাহাড়ের কাঁধ ঘেঁষে রোদ এসে চিকচিক করছে নদীর পানি। মা আর আমি রোদ পেয়ে হাতপা ছড়িয়ে গাড়ির ভিতর বসে আছি। দূরে দেখা যায় পাহাড়ের চূড়া। এর মধ্যে ঘর বেঁধে বসে আছে মানুষ। এরা এখানে বেশির ভাগ কৃষি কাজ করে। এখন শীতকাল তাই কোনো আবাদী ক্ষেত দেখা যাচ্ছে না সেরকম। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে এখানের মানুষের প্রধান কাজ কৃষি কাজ, পশুপালন আর উঠানে সব্জিবাগান করা।
২.
দেড় ঘণ্টা লাগল থিম্পু পৌঁছাতে। থিম্পু ভুটানের রাজধানী। তাই মনে মনে আশা করছিলাম শহরটা বড় হবে। পারোর মত ছোট হবে না। পারো শহরের চাইতে থিম্পু বড় কিন্তু যত বড় ভেবেছিলাম তত বড় না। আসলে ঢাকা, নিউইয়র্ক, ইস্তানবুল বা ব্যাঙ্কক শহর দেখলে থিম্পুকে শহর হিসাবে ছোট মনে হওয়ারই কথা। শহরে ঢুকে প্রথমে আমরা দুপুরের লাঞ্চ করলাম। সোনেম আমাদের নিয়ে গেল একটা শস্তা হোটেলে। হোটেলের নাম তান্দিন। এখানে যেমন ইন্ডিয়ান টুরিস্ট আসে তেমনি এটি ইউরোপীয়দের মধ্যেও যে জনপ্রিয় সেটা বোঝা গেল বিভিন্ন ধরনের মানুষের আসা-যাওয়া দেখে। হোটেলটার ভিতরে খুব ঠাণ্ডা। আমরা হোটেলে রেজিস্ট্রেশন করে ব্যাগ রেখে বের হয়ে গেলাম। প্রথম কাজ ভুটানের আরেকটি ডিসট্রিক্ট পুনাখা যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন অফিস থেকে পারমিশন নেয়া। মাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আমি পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসে ঢুকলাম। সেখানে দেখা হল নানানদেশী টুরিস্টদের সাথে। এর মধ্যে কালো পোশাক পরে বিশাল মোটর সাইকেল নিয়ে থামতে দেখা গেল কয়েকটি যুবককে। এরা এসেছে ইন্ডিয়া থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে ভুটান ভ্রমণ করতে। পৃথিবীতে কত ধরনের ভ্রমণপিয়াসী মানুষ আছে!
ইমিগ্রেশন অফিস থেকে বের হয়ে আমরা থিম্পু শহর দেখতে বের হলাম। আমাদের হাতে মাত্র এক ঘণ্টা আছে। এর মধ্যে গাড়িতে করে ঘোরাঘুরি করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। গাড়ি ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। অনেক ওপরে একটা জায়গায় গিয়ে সোনেম গাড়ি থামাল। আমরা নামলাম। সোনেম দূরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল ওই দিকে রাজার বাড়ি। কিন্তু খুব বেশি কিছু দেখতে পেলাম না। পড়ন্ত বিকালে পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতেই বেশি ভাল লাগছিল। সোনেম আমাকে আর মাকে ছবি তুলে দিল আর বলল সে আমাদের এখন নিয়ে যাবে আর্ট স্কুলে। সোনেমের কথা শুনে আমি আর সময় না নিয়ে গাড়িতে উঠে গেলাম। এই শীতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকাটাও কঠিন। গাড়ি একই পথ ধরে আবার নিচে নামতে থাকলো। প্রায় ১৫ মিনিট ড্রাইভ করার পর গাড়ি গিয়ে পৌঁছাল একটা বিশাল গেটের সামনে। আমি আর মা গেট দেখেই খুশি। এই গেটটিকে আর্ট স্কুলের গেট মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে একটা মন্দিরের গেট। ভিতরে ঢুকে দেখি লামাদের পোশাক পরে ছাত্রছাত্রীরা ঘুরছে। একটা ক্লাসরুমে উকি দিয়ে দেখি ভিতরে ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ গোল হয়ে বসে কথা বলছে, কেউ কেউ ভাষ্কর্য বানাচ্ছে, কেউ কেউ পটারির সরঞ্জাম জড়ো করছে।
কয়েকটা ভাস্কর্য কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করলাম। বেশির ভাগই বৌদ্ধের মূর্তি। বিভিন্ন আকৃতি ও মাধ্যমের। একটা কাজের দিকে চোখ আকৃষ্ট হল। কয়েকটা ছোট ছোট নারীমূর্তি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে নাচের ভঙ্গি করে। কোনো মূর্তিরই হাত নেই। আরেকটু কাছে গিয়ে ভাল মত দেখি প্রত্যেকটা মূর্তি একই ভঙ্গিতে দাঁড়ালেও একেকটা মূর্তির হাতের ও পায়ের পজিশন আলাদা। এই মূর্তিগুলো একসাথে দেখে প্রথম মনে হয়েছিল মডার্ন ভাস্কর্য কিন্তু কাছে গিয়ে দেখি পুরানো একটা ফর্ম। আমার একটু আগ্রহ হল জানতে যে ভুটানের আধুনিক শিল্পচর্চার ধরনটা তাহলে কী? এখানকার শিল্পচর্চা কি মূলত ধর্মকেন্দ্রিক? এর পর যতদিন ছিলাম খোঁজার চেষ্টা করেছি নতুন কোনো ফর্ম দেখা যায় কিনা। আমার চোখে পড়েনি বলে যে নেই সেটাও মেনে নিতে পারি না। বের হয়ে সোনেমকে জিজ্ঞেস করলাম আর কোনো বড় আর্ট স্কুল বা কলেজ আছে কি না। সোনেম বলল, নেই।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়। আমরা হোটেলের দিকে রওয়ানা দিলাম। প্রায় চলে এসেছি কাছে তখন মনে হল একটু হ্যান্ডিক্রাফটের দোকান ঘুরে গেলে কেমন হয়। কিন্তু গিয়ে দেখি ততক্ষণে সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু দোকান খোলা দেখা যাচ্ছিল, দেখে নামলাম। কিন্ত গিয়ে বুঝলাম এগুলো টুরিস্টদের দোকান নয়। এখানে পাওয়া যায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য্য জিনিস। কী ধরনের কাপড় বা জিনিসপত্র ভুটানিরা ব্যবহার করে সেটা বোঝার জন্য একটু ঘুরাঘুরি করলাম। আবিষ্কার করলাম যা পাওয়া যায় তার অধিকাংশই ইন্ডিয়া, চায়না ও বাংলাদেশ থেকে আসা। একটু হাঁটাহাঁটি করে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। কিন্তু হোটেলের ভিতর এত ঠাণ্ডা যে মন চাইল রেস্টুরেন্টে বসেই কাটাই। আমি আর মা খাবার অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছি তখন দেখি আমাদের পাশের চেয়ারে এসে বসেছে একজন লম্বা ইয়োরোপীয় লোক আর তার সাথে একজন ইন্ডিয়ান। তারা ঢুকেই প্রথমে দুইটা বিয়ার অর্ডার দিলেন। তাদের কথা যাতে শুনতে না হয় সে জন্য আমি টিভির দিকে তাকালাম। কিন্তু কথা না শুনে থাকা যাচ্ছে না। কারণ তারা কথা বলছেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এবং ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক ব্যাখ্যা করছেন কেন তিনি মনে করেন এই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উন্নয়ন সংস্থাগুলি যতটা উদ্বিগ্ন ততটাই নিষ্কর্ম!
আমি ভাবলাম, গত কয়েকদিন ধরে আমি জলবায়ু পরিবর্তনের উপর লিখছি কিন্তু এখানে এসেও দেখি এই কথাই শুনতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত ব্যক্তিরা এখানেও পৌঁছে গেছে!
যেহেতু মা চুপচাপ বসে আছে আর পাশের টেবিলের লোকগুলোর গলার আওয়াজ বিয়ারের জোরে আরো বাড়ছে–তাদের গল্প শুনতে শুনতে খাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায়ই ছিল না। চিকেন মোমো, ভাত, মাছ, আর সব্জি দিয়ে আমরা প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ডিনার করলাম। তারপর মা আর আমি খরগোশের মত প্যাকেট হয়ে লেপের নিচে ঢুকে গেলাম।
৯ ডিসেম্বর ২০১০, তান্দিন
থিম্পুর তান্দিন হোটেলের ভিতর যমের ঠাণ্ডা। বিছানা থেকে উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু উঠে রেস্টুরেন্টে বসে যখন পুরি-সব্জি খাওয়া শুরু করলাম তখন মজার খাবারের আমেজে ঠাণ্ডার কথা ভুলে গেলাম। আরো ভুলে গেলাম আগের রাতের শীতের স্মৃতি, যখন গাড়ি চলতে শুরু করল পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা ঢাল দিয়ে পুনাখা শহরের দিকে। যত বেলা যায় রোদের তেজ তত বাড়তে থাকে। বেলা সোয়া এগারোটায় শহর ছেড়ে গাড়ি যখন গ্রামের পাহাড়ি রাস্তা ধরে যাচ্ছে তখন দেখি রাস্তার ধারে টেবিলের উপর বিভিন্ন প্রকার ফল সাজিয়ে বসে আছে ভুটানি মহিলারা। সোনেমকে বললাম থামতে। বিভিন্ন রঙের ও সাইজের আপেল পলিথিন প্যাকেটে ভরে বিক্রি করছে এক মহিলা। তার পিছনে সূর্য পাইন গাছ আর শুকিয়ে যাওয়া আপেল গাছের মাঝখান থেকে উঁকি দিচ্ছে। এরকম আপেল গাছ ঘেরা আপেলের দোকান থেকে আপেল কিনে খেতে মন চাইবেই। কিন্তু আপেলের চেহারা দেখে সেই ইচ্ছাটা আর করল না। কারণ এটা আপেলের সিজন না। দেশে-বিদেশে রফতানির পর অবশিষ্ট আপেলগুলি প্যাকেটে সংরক্ষিত হয়ে এই মুহূর্তে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এদের স্বাস্থ্য তত ভাল না, জায়গায় জায়গায় পচন দেখা যাছে। এর মধ্যেও বেছে কয়েকটা আপেল কিনলাম। মা গাড়িতে উঠে আপেল খাওয়া শুরু করল কচ কচ শব্দ করে।
আপেল খাওয়ার কচ কচ শেষ হতেই দেখি ব্লু পাইন গাছের ঘনত্বও বাড়ছে। আমরা যেই পাহাড়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি সেটাতে ব্লু পাইন গাছ বেশি। কিন্তু দূরে পাহাড়ের উপরে যে পাইন গাছ দেখা যাছে তার জাতটা আবার ভিন্ন। পাইন গাছ দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছালাম একটা রাস্তার বাঁকে। এখান থেকে দূরে বিভিন্ন ধরনের পাহাড় দেখা যায়। সবচাইতে কাছেরগুলি সবুজ আর বাদামি, তার পরের সারি নীল এবং তার পরের সারি সাদা। নাম না জানা যেই সব চূড়া মাথায় বরফ নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের চোখ চলে যায় সেইসব অজানা সাদার দিকে। মা বলল দার্জিলিংয়ে এরকম সারি সারি পাহাড়ের দৃশ্য দেখা যায়। এইসব দৃশ্য আমাদের এত টানে কেন? এই সব দৃশ্য কেন এত রহস্যে ঢাকা? এর মধ্যে কি লুকিয়ে আছে আমাদের জন্ম মৃত্যু, আমাদের আগের ও পরের জন্ম?
আমার মনে হচ্ছিল সোনেমের একটু রেস্ট দরকার। আমাদের বা দিকে পাহাড় আর ডান দিকে সারি সারি গাছ। আমি সোনেমকে বললাম চা খাওয়ার জন্য কোথাও থামতে। সামনে একটা রেস্টুরেন্ট দেখে সোনেম গাড়ি থামাল। বেলা সাড়ে এগারোটা হবে তখন। রেস্টুরেন্টের ভিতরে কাস্টমাররা ঘরোয়া পরিবেশে চা খাচ্ছে আর টিভি দেখছে। আমিও একটা চা নিলাম। কাউকে দেখে বোঝার উপায় নাই কে কাস্টমার আর কে রেস্টুরেন্টের লোক। সোফায় বসে থাকা যুবককে জিজ্ঞেস করলাম “আপ ইয়াহাপে কাম কারতেহে?”
উনি একটু হেসে জবাব দিলেন “ম্যায় কাস্টমার হু, ট্রাক চালাতিহু।”
আমি বললাম, “আপ কা নাম কেয়াহ্যা?”
“মেরা নাম জোখ বাহাদুর রাই, আপলোগ কাহাছে আরাহে হে?”
আমি বললাম “বাংলাদেশ, পুনাখা যায়েগা আভি।”
“হাম ভি পুনাখা যাতেহে, সিমেন্ট লেকার ভুতং ছে পুনাখা মে পউছনাহে।” ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে প্রতি বাক্যে ক্রিয়াপদকে যথাসম্ভব পেচিয়ে, হিন্দির কাছাকাছি কোনো একটা ভাষা বলে ও শুনে যা বুঝলাম তা হল এই ট্রাক ড্রাইভার সেই ট্রাক ড্রাইভারদের একজন যারা ভুটান থেকে বাংলাদেশে আপেল ট্রাকে করে নিয়ে যায়। উনি আরো জানালেন যে বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক ভুটানে আসে কাজ করতে। কেউ মিস্ত্রী, কেউ অপারেটর, কেউ দোকানে কাজ করে।
চা খেতে খেতে দোকানের ভিতরটা ভাল ভাবে লক্ষ করলাম। রেস্টুরেন্টের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা হিটার, সেটা থেকে একটা পাইপ ছাঁদ পর্যন্ত উঠে গেছে। নিচের অংশটা গোল একটা ড্রামের মত। এর ভিতরে লাকড়ি দিয়ে আগুন জলছে আর পাইপ দিয়ে ধোয়া উঠে যাচ্ছে ছাদে। নিচের ড্রামের মত অংশটা দেখে বোঝা যায় এটা অনেক পুরানো পদ্ধতির হিটার। শহরে এ ধরনের হিটার দেখা যায় না। রুমের মধ্যে হিটারের পর সবচাইতে বেশি চোখে পড়ে কাচের শোকেস। কাচের শোকেসে একটা অদ্ভুত ধরনের খাবার দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম শুকরের মাংস মশলা মাখিয়ে ড্রাই করে রাখা। এখানকার খুব প্রচলিত খাবারের একটি। দেয়ালে শেলফে সাজান রয়েছে বাংলাদেশ থেকে আসা প্রাণ জুস। শোকেসের পিছনে ক্যাশে যে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে সে তিব্বতীয় বংশোদ্ভূত। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে এই এলাকাতে বেশির ভাগ লোক তিব্বত থেকে রেফ্যুজি হয়ে এসেছিল এবং বংশপরম্পরায় এখানেই আপেল চাষকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। চা খেয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে দেখি রাস্তার ঠিক উল্টা দিকেই পাহাড়ের উপর তিব্বতি রেফ্যুজিদের বাড়ি। আর বাড়ির সামনে শুকনা আপেল গাছ। এসব আপেল গাছের আপেল আমাদের দেশের ফলের দোকানে সাজানো থাকে।
জোখ বাহাদুর রাই ছোট খাট মানুষ। সে সাদা রঙের বিশাল ট্রাকে গিয়ে উঠল। আর এদিকে ছয় ফুট লম্বা সোনেম উঠলো নীল রঙের ছোট্ট একটা গাড়িতে। মনে মনে বললাম “সব আল্লাহর ইচ্ছা।” রওনা দিলাম আমরা। ঘটনাবিহীন দুই ঘণ্টা পরে পৌঁছে গেলাম পুনাখা। আরেকটা সুন্দর শহর চোখের সামনে হাজির হল তার প্রাণ নিয়ে। এই প্রাণটি হল এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নীল রঙের নদী। উপর থেকে মনে হচ্ছে একটা নীল সাপ এঁকেবেঁকে হেঁটে যাচ্ছে। এই নদী যেন এই সবগুলি পাহাড়ের প্রাণ।
Damchen4.jpg
রিসোর্টের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দামচেন নদী।
গাড়ি গিয়ে থামল একটা রিসোর্টে। নাম ‘দামচেন রিসোর্ট’। রুমের ভিতরে গিয়ে দেখি একটা দেয়াল জুড়ে বিশাল জানালা। আর জানালা দিয়ে দেখা যাছে সেই নদী। থিম্পুর ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস থেকে এসে যখন দেখি সূর্যের কিরণে নদী চক চক করছে আর তার আভা যখন ঝির ঝির বাতাসে দুলে দুলে গাছের পাতায় খেলছে তখন মন চায় শুধুই তাকিয়ে থাকতে। করলামও তাই। বেশ কিছুক্ষণ বসে বসে তাকিয়ে রইলাম যেন কোথাও এই চোখ স্থির নয়, যেন কোথাও এই বাতাস স্থির নয়, যেন কোথাও এই পাহাড় স্থির নয়। একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম। বই পড়তে পড়তে এক সময় চোখ বন্ধ হয়ে গেল। একবার যখন চোখ খুললাম, দেখি পাহাড়ের উপর অন্ধকার নামছে। নদীর পানি আরো নীল হয়ে গেছে। আমার চোখ আবার বুঁজে এলো।
যখন চোখ খুলল তখন পুরাপুরি অন্ধকার। আমি শুধু ঘুমাইনি আমার মাও ভাল ঘুমিয়েছে।
কয়েকবার ডাকাডাকির পর সে উঠল। আজকে মাকে রানীর মত লাগছে। কেন লাগছে জানি না। মনে হয় অনেকদিন পর মাকে দেখলাম অসময়ে বেভোর ঘুমাচ্ছে। মা আর আমি আমাদের দীর্ঘ ঘুম নিয়ে একটু হাসাহাসি করলাম। তারপর গেলাম পুনাখা টাউনে রাতের খাবার খেতে। সোনেম বলল এক নেপালি আন্টি নাকি ভাল রাঁধে। যেয়ে দেখি নেপালী আন্টি ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টের ভিতর বসে বসে হিন্দী ড্রামা সিরিয়াল দেখছে। রান্না খাওয়াতে তার মোটেও আগ্রহ নাই। টিভির দিকে তাকিয়ে অর্ডার নিয়ে আবার টিভির দিকেই তাকিয়ে রইলো। তার ওখানে ভাত, ডাল, সব্জি আর মাছ ভাজা দিয়ে রাতের খাবার সারলাম। খাবারটা মোটেই ভাল ছিল না। তারপরও যেহেতু সোনেম আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের কিছুই করার ছিল না। রুমে ফিরে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম। একটু বই পড়লাম। তারপর আবার ঘুম।
১০ ডিসেম্বর ২০১০, পুনাচু
ভোর বেলা দরজা খোলার আওয়াজ শুনে ঘুম ভাঙল। দেখি মা পা টিপে টিপে বের হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কই যাও। মা বলে একটু হেঁটে আসি। এদিকে আমার লেপের নিচের আরাম রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। ঘড়িতে সাতটা বাজে। আমি ঘরের সব পর্দা সরিয়ে দিলাম। উপরে পাহাড়ের উপর ঘন কুয়াশা আর মেঘ একাকার হয়ে আছে। নিচে পুনাচু নদীর নীল পানি দুই ধারে সাদা পাথরের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলছে। সাদা পাথরগুলি দেখে মনে হয় মেঘের ডিম। যেন ভোর রাতে এই ডিম থেকে বাষ্প বের হয়ে মেঘেদের জন্ম হয়। সাদা লেপের নিচে ওম নিতে নিতে দূরে পাহাড়ের উপর গাছগুলির দিকে তাকিয়ে রইলাম। এক সময় সূর্য মেঘের আড়াল থেকে বের হয়ে এলে মেঘ আর কুয়াশা আলাদা হল। এখন পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সাদা মেঘ দেখে ভাবছি, সারাদিন ধরে দৃশ্যপটের এই পরিবর্তন কয়েকদিন একটানা দেখতে থাকলে হয়ত কখনো বুঝতে পারব পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের কোনো সম্পর্ক আছে কি না। মনে পড়ল মহেশখালিতে পাহাড়ের উপর বৌদ্ধ মন্দির দেখেছি, মনে পড়ল চট্টগ্রামে, বান্দরবান, রাঙামাটিতে রয়েছে বৌদ্ধ মন্দির। তাহলে কি দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে পাহাড়ি অঞ্চলগুলিতেই বৌদ্ধ ধর্মীয় মানুষ বেশি থাকে?
বাইরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি মা হেটে রুমের দিকে আসছে। আটটা বেজে গেছে। আমি উঠে হাতমুখ ধুয়ে চা বানালাম। ততক্ষণে ঘরের ভিতর রোদ চলে এসেছে। মা আর আমি সামনে নদীর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চা আর বিস্কুট খেলাম। রোদ এসে আমার মুখে পড়ছে। এই কয়েকদিনের সর্দি আজকে থেকে বোধহয় শেষ হল। এক ঘণ্টা ধরে দুই কাপ চা খেয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরা হয়ে গেল। চা খেয়ে মা এবার রোদ পোহাতে বসল বাইরে। আমি আবার বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকলাম। এবার চলছে দিবাস্বপ্ন — পরিবর্তনের কাহিনীর দ্বিতীয় পর্ব। কোথায় গেল ভোরের কুয়াশা? কোথায় গেল সাদা মেঘ? সবাই চলে গেছে, রয়ে গেছে পাহাড়। দাঁড়িয়ে একা একা। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে গ্রাম থেকে মানুষেরা নামছে, নামছে গরুও। রাস্তা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে।
কথা ছিল সকালে নেপালি আন্টিজির রেস্টুরেন্টে নাস্তা খেয়ে বের হব। কিন্তু সকালের চা-বিস্কুট এখনো আমাদের দিব্যি শক্তি দিয়ে চলেছে। তাই গাড়িতে উঠেই সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর নাস্তা করব না, বরং একটু ঘুরে এসে একবারে দুপুরের খাওয়া খাব। বের হয়ে পড়লাম আমরা। গাড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। আমরা দেখতে যাচ্ছি একটি মন্দির। মন্দিরটি একেবারেই নতুন। মাত্র তিন মাস হল এই মন্দির প্রার্থনা করার জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। আমরা যখন পৌঁছলাম মন্দিরে তখন বেলা পোনে এগারটা। সকালের রোদ ধীরে ধীরে প্রখর হচ্ছে। ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে সিংগে ওয়াংচুকের চারজন স্ত্রী ছিল। তাদের একজনের বাবা পুনাখা জেলায় অনেক সম্পত্তি ও হোটেল বানানোর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ করেছেন। তার একটি হচ্ছে এই মন্দির। এই মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ হবার পর মন্দিরটিকে সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে তিন মাস আগে। আমি এর আগে যত মন্দিরে গিয়েছি তার সবগুলোই ছিল শ খানেক বছরের পুরানো। নতুন মন্দিরটি দেখে আমার অন্য রকম ভাল লাগল। নতুনের মধ্যে লক্ষ করলাম এখানে দেয়াল জুড়ে কাচের বাক্স বানানো হয়েছে । টানা কাচের বাক্সের ভিতর রাখা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের মূর্তি।
আজকে থেকে ১০০ বছর পর এই মন্দিরটি দেখতে কেমন হবে তা নিয়ে যখন ভাবছি তখন হঠাৎ মনে হল কাচের এই ব্যবহার কি নতুন নাকি অনেক আগেও কাচ ব্যবহার করা হয়েছে। হতে পারে কাচ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এইরকম করে দেয়ালে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা আমি জানি না। ব্যাংককের মন্দিরে বোধহয় দেখেছিলাম এরকম কাচের ব্যবহার। কিন্তু সেটাও ছিল অন্য রকম। এই ধরনটা আমার কাছে কিছুটা আধুনিকই মনে হল। মন্দিরের ভিতরের সব কিছু চকচক করছে, একজন মাথান্যাড়া মহিলা লামা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এক মনে বই পড়ছে। আমাদের দেখে বৌদ্ধের মূর্তির সামনে রাখা বহুরঙ্গের কারুকাজ করা সরু নলওয়ালা একটা ছোট্ট কেতলি থেকে প্রথমে সোনেমের হাতে পানি দিল। সোনেম ভক্তি ভরে সেই পানি খেল। তাকে দেখে আমরাও খেলাম একে একে। পানি খাওয়ার দিকে মন দেয়ার থেকে আমার মন বেশি ছিল কেতলিটার দিকে। মনে হল পানি তো খেলাম না, খেলাম কোনো সুগন্ধি।
মন্দির থেকে বের হয়ে সামনে দেখি একটা মহিলা ঘাস কাটছে আর তার বাচ্চা একটা সাদা উঁচু টুপি পরে তার পাশে খেলছে। মন্দিরের প্রবেশ পথ বরাবর একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। সেখানে সিঁড়ির ময়লা পরিষ্কার করছে এক যুবক। আমার একজন প্রিয় বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল। আমার এই বন্ধুটি একটি কবিতা সময়ে-অসময়ে বার বার আবৃত্তি করত। “হুজুর, মসজিদের এই মার্বেল পাথরগুলি পরিষ্কার করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই।” মন্দিরের সামনে ঘাস কাটা ও ময়লা পরিষ্কার করার তদারকির দায়িত্বে ছিলেন এক ভদ্রলোক। আমি তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম “আপ ইয়াহা কেয়া কারতেহে?” লোকটি আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “ম্যায় গভমেন্ট অফিস মে কাম কারতি হু, ইস জাগামে কাম দেখনেকিলিয়ে আতিহু। থিম্পুমে রাহতি হু।” এর পর উনি আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলে যেতে লাগলেন। আমি হিন্দি ভাল বুঝি না, বলতেও পারি না। আর সে যেই ভাষায় কথা বলেছিল সেটা লেখা আমার জন্য কঠিন। তাই সংক্ষেপে আমি তার কাছে যা শুনলাম তাই লিখে যাচ্ছি।
ভুটানি পোশাক পরা এই ভদ্রলোক প্রথমে জানতে চাইলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি। যখন শুনলেন আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তখন উনি বললেন যে উনার স্ত্রী বাংলাদেশে ব্যবসার জন্য প্রায়ই যান। সেই কারণে তাকেও কয়েকবার যেতে হয়েছে। তার স্ত্রী বাংলাদেশ থেকে খাবার, কসমেটিক্স, ড্রিঙ্কস ইত্যাদি আমদানি করেন। বাংলাদেশ থেকে এই সব মাল জাহাজে করে কলকাতা পর্যন্ত আসে, সেখান থেকে আসে ভুটানে।
আমার মার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন আমার সাথের মহিলাটি কে। যখন শুনলেন এই মহিলাটি আমার মা তখন উনি বলতে শুরু করলেন, আমি এক লামাকে চিনি বাংলাদেশ থেকে আসে। প্রায় দেড়শ বছর আগে এই লামা তার মাকে খুঁজতে খুঁজতে পুনাখাতে এসেছিল। সে জানত তার মা পুনাখাতে কোনো এক পাথরের নিচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। তার মা কোনো পাপ করেছিল বলে তার ছেলে মায়ের পাপমুক্তির জন্য লামা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক দিন থাকার পর তার মনে হয়েছিল সে তার মাকে খুঁজে বের করবে। যেহেতু লামারা কারো অস্তিত্ব কল্পনা করলে তা কোথায় সেটা বলে দিতে পারেন ওই লামা জানতেন যে তার মা রয়েছে পুনাখাতে একটা কিরা হয়ে। সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেছিল সেই লামা এই পুনাখা শহরে। পুনাখাতে এসে সে এই পাথরের কাছে বসেছিল অনেক দিন–যদি মায়ের দেখা মেলে। ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাকে এই পাথরের কাছে বসে থাকতে দেখে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে এই লোকটি কে? পুনাখাতে কেউ জানত না যে সে একজন লামা। এরই মধ্যে লামার অধ্যবসায় দেখে ভগবান একদিন প্রসন্ন হলেন। সকলকে অবাক করে আকাশ থেকে এক শক্তি এসে বিশাল সেই পাথরকে দুই খণ্ড করে দেয়। তার ভিতর থেকে বের হয়ে আসে একটা বিচ্ছা। হিন্দিতে যাকে বলে “কিরা”। এই কিরা বের হয়ে যেদিকে যায় লামা তার পিছন পিছন যায়। এটা দেখে গ্রামের মানুষ বুঝতে পারে এই লোক যেই সেই লোক নয়, সে একজন লামা। লামা তখন তার পাপমুক্তির জন্য সেই কিরাকে পুনাচা নদীর পানিতে ছেড়ে দেয়।
10.JPG
কিংবদন্তীর পাথর: শখানেক বছর আগে নাকি এক বাঙালি লামা এই পাথরের নিচে তার মায়ের আত্মাকে খুঁজতে এসেছিল।
কিন্তু তাতেও তার মায়ের পাপমুক্তি ঘটে না। এরপর তার মা জন্ম নেয় আরেকটি কিরা হয়ে। এবার সে তার পিছু নেয় কিন্তু এভাবে যেতে যেতে লামা দেখে যে কিরাটি আস্তে আস্তে এক গ্রামবাসীর রান্নাঘরের চুলার ভিতরে ঢুকে যায়। সে অপেক্ষা করে কিরা কখন বের হয়ে আসবে। কিন্তু কিরা আর বের হয় না। এটা দেখে সেই লামা ওই চুলার মালিকের বাড়িতে কাজ নেয়। সে বাড়ির সব কাজ করত। একদিন সে ভাবে কিরা আর ফিরবে না। তাই সে ঠিক করে বাংলাদেশে চলে যাবে। কিন্তু বাড়ির মালিক লামাকে ছাড়তে চায় না। তাকে অনেক সোনাদানা দিতে চায়। কিন্তু লামা কিছুই নিতে চায় না। সে বলে তার কাজ শেষ, তাকে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু তারা যদি কিছু দিতে চায় তাহলে একটা জিনিসই লামা নিতে পারে। আর তা হল মাটির চুলা। শেষ পর্যন্ত বাড়ির মালিক রাজি হয়। মাটির চুলা ভাঙা হয়। তখন ওই কিরা বের হয়ে আসে। লামা ওই কিরাটিকে নিয়ে নদীর পানিতে ছেড়ে দেয়। লামার মায়ের পাপমুক্তি ঘটে। লামা ফিরে যায় বাংলাদেশে। এখনো ওই লামা বেচে আছে এবং বাংলাদেশে আছে।
গল্প শুনতে শুনতে দেখি আমাদের পাশ দিয়ে ১২-১৩ বছর বয়সী ৪-৫ টা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম এরা কারা? উনি বললেন এরা লামা ছাত্রী। এরা এখন স্কুলে পড়ছে। বড় হয়ে এরা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে। এখানে এখন প্রায় ৬০ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। আর এক বছরের মধ্যে এখানে ১০০ জন ছাত্র-ছাত্রীর আবাসিক ব্যবস্থা হবে। এটা ভবিষ্যতে একটা ইউনিভার্সিটি হবে। গভমেন্ট অফিসার গল্প বলতে বলতে অনেক দূর থেকে কাছে চলে আসছিলেন। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল উনি গায়ের উপর উঠে আসবেন। তখন মনে হল উনাকে এখানেই থামানো উচিত। এর চাইতে বেশি গল্প বলতে দিলে উনি মাথায় উঠে যাবেন। আমরা বিদায় নিয়ে ফিরে আসার সময় উনি আমাকে বললেন মরিচ, তেল আর মাংস কম খাবেন, নাহলে তাড়াতাড়ি বুড়ি হয়ে যাবেন। আমার মা আর সোমেন কথা বলছে এই অফিসারের বাচালতা নিয়ে। তাদের কথা আর গভমেন্ট অফিসারের বাড়তি বকবকানি ছাপিয়ে আমি তখন কল্পনায় দেড়শ বছর আগে ও দেড়শ বছর পরে চলে গেছি।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে ঠিক করলাম দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর যাব ভাঙা পাথর দেখতে। তাই আমরা গেলাম নেপালি আন্টিজির হোটেলে। অর্ডার দিলাম ভাত, মাছ ভাজা, সব্জি আর ডাল। অর্ডার দিয়ে যখন বসে আছি তখন দেখি লাল রঙের কাপড় পরে ন্যাড়ামাথা ১৪-১৫ বছর বয়সী দুইটা ছেলে ঢুকল। আমাদের দেশে ১৪-১৫ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা যেমন ফাস্টফুডের দোকানে খেতে আসে তেমনি এসে ছেলেদুটো সিঙ্গারা অর্ডার দিল। আমি তাকিয়ে ওদের পরনে লামাদের কাপড় দেখছি। ছেলেদুটো টিভির দিকে মুখ করে বসল। আমরা তাদের পিছনে কোনাকুনি একটা টেবিলে বসে। টিভিতে তখন দেখাচ্ছে কউন বানেগা ক্রোড়পতি। অমিতাভ বচ্চন কথা বলছেন। ওরা টিভি দেখছে আর নিজেদের মধ্যে ওদের ভাষায় কথা বলছে। আমি বুঝলাম না ওদের কথা কিন্তু লক্ষ করলাম ওদের হাবভাব ও চালচলন। চট করে কী মনে করে একটা ছবিও তুলে ফেললাম। ছবি তুলে মনে হল আমি আসলে ভাবছিলাম বিশ্বায়নের কথা।
Bhutan 175.jpg…….
নদ ও নদীর মিলনস্থল।
……..
নেপালি আন্টিজির ফাঁকিঝুকি রান্না খাবার খেয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম জং-এর দিকে। জং মানে দুর্গ। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এটা কোনো দুর্গ। দুর্গটা নদীর মাঝখানে একটা দ্বীপের মধ্যে। এক পাশ থেকে একটা নদ আর অন্য পাশ থেকে একটা নদী এসে মিলেছে এখানে। আমি সোনেমকে জিজ্ঞেস করলাম নদ ও নদীর মধ্যে পার্থক্য কী। সোনেম আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। মা বলল, “নদ হছে উশৃঙ্খল, আর নদী হছে শান্ত।” আমি বললাম “কী রকম?” মা বলল, “এই যেমন কপোতাক্ষ হচ্ছে নদ, আর পদ্মা হচ্ছে নদী। নদের ভাঙন আর বয়ে চলা সর্বগ্রাসী। আর নদীর গভীরতা বেশি কিন্তু নদীর ভাঙন আর বয়ে চলার মধ্যে আছে একটা শিষ্টতা যা সাধারণত নারীর মধ্যেই লক্ষ করা যায়।” আমার মনে পড়ে গেল এই প্রশ্ন আমি অনেক মানুষকে করেছি, আবার অনেক মানুষ আমাকেও করেছে। কেউ আমাকে সঠিক জবাব দেয়নি।
এইসব ভাবতে ভাবতে দুর্গের সামনে চলে এলাম। দুর্গের মূল ফটকে ঢুকতে হলে একটা ৫৫ মিটার লম্বা ক্যান্টিলিভার ব্রিজ পার হতে হয়। ব্রিজের দুই পাশে যতদূর চোখ যায় মনোরম দৃশ্য–পাহাড় আর নদ-নদীর অপূর্ব মিলনস্থল। ব্রিজ পার হয়ে ভিতরে ঢুকে দেখি ডান দিকে দুর্গের উঁচু দেয়াল। ভিতরে ঢুকতে হলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হয়। মা পারবে না অত উপরে উঠতে। তাই মাকে রোদ পোহাতে বসিয়ে রেখে আমি সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠে গেলাম। দুর্গটা খুব বেশি বড় না। চার পাঁচ তলা সমান উঁচু হবে। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ভুটানিরা বানিয়েছিল এই দুর্গ তিব্বতীয় আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য। চারিদিকে দালানে ঘেরা মাঝখানের বিশাল কোর্টইয়ার্ডে বেশিরভাগ জায়গায় ছায়া পড়ে আছে। যেই জায়গাটুকুতে সূর্যের আলো এসে পড়েছে সেটা দেখে আমার মনে হয়েছে এই আলো কোথায় যেন আমি দেখেছি আগে। তবে কি আমারও পুনর্জন্ম হয়েছে নাকি? একে একে লাল কাপড় পরা লামারা হেঁটে যাচ্ছে। আমি তাদের দেখছি আর ভাবছি কী হল আমার। এই ধর্মীয় পরিবেশের আছড় কি আমার উপর পড়েছে? পুনর্জন্মের কথা ভাবতে না চাইলেও কি এরকম পরিবেশে এই ভাবনা তৈরি হয়?
কোর্ট ইয়ার্ডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দিবাস্বপ্নে যখন বিভোর আমি তখন দেখি একজন লামা দরজা খুলে দিয়ে আমাকে ডাকছে। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। কাঠের উঁচু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। বিল্ডিংয়ের মূল দরজাটা বিশাল বড়–কাঠের খোদাই করা। ভিতরে ঢোকার পর লামা ইশারা করে আমাকে বলল ভিতরের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে। আমি লামাকে অনুসরণ করলাম। আমার পিছনে কয়েকজন চাইনিজ যুবক আর যুবতী উঠে আসছে। কাঠের সিঁড়িগুলো খুব খাড়া, সারাক্ষণ মনোযোগ দিতে হয়। লামা উঠছে, আমি তার পিছনে উঠছি। একটার পর একটা সিঁড়ি। উপরে ওঠা আর শেষ হয় না যেন। মনে হল পাঁচতলা পর্যন্ত উঠলাম। উঠে দেখি একটা ঘরে বৌদ্ধের দুইটা মূর্তি পাশাপাশি। তফাৎ হছে একটা মূর্তির মুখের মধ্যে উদ্বেগের ছায়া। অন্য মূর্তির মুখটা একটু কাত করা, প্রসন্ন ভাব। এই পার্থক্যটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আমি কাঠের জানালার পাশে বসে বৌদ্ধের মুখভঙ্গি দেখছি আর হঠাৎ একটা শূন্যতা বোধ করলাম। এই পরিবেশ, এই অবয়ব, এই গন্ধ, এই প্রাচীন কাঠ মনে হল আমার অতি পরিচিত। আমার সামনে বসে পূজা করলেন চাইনিজ পরিবারের সদস্যরা। হঠাৎ মনে হল আমি মায়ের কাছে যেতে চাই। আমি নেমে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে হল আমি কখন মায়ের কাছে যাব। দুর্গে ঢোকার মূল সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মাকে দূর থেকে দেখে আশ্বস্ত হলাম।
দুর্গ থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম একটা হ্যান্ডিক্র্যাফটের শোরুমে। এটি আসলে একটি ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন। ঘুরে ঘুরে দেখে আমি দুইটা বুকমার্ক কিনলাম। টাকা দেয়ার সময় দেখি ওই সেন্টারে কয়েকটি বই রাখা। তার মধ্যে সবচাইতে উপরের বইটির নাম “গালিভার’স ট্রাভেলস”। তার পাশে আরেকটি বই। সেটার নাম “ইয়ুথ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট”। বইগুলো দেখে বোঝা যায় এই বইগুলো কেউ কখনো পড়েনি। আর ইয়ুথ লিডারশিপ যে “ইয়ুথ লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট” নামের বই পড়ে হয় এই ধারণা যেই প্রতিষ্ঠান চর্চা করে… তা থেকে বুঝলাম এটা একটা এনজিও উদ্যোগ।
যেই বইই পড়ুক না কেন ভুটানি যুবক-যুবতীরা আলোয় আলোয় আলোকিত হোক সে আকাঙ্ক্ষা করতে করতে আমরা রওয়ানা দিলাম সেই পাথর দেখতে। যেই রাস্তা দিয়ে গেলাম তার দুই পাশে লাল ফুলের গাছ। গাছগুলির নাম জানি না। কিন্তু ভাবতেই ভাল লাগে আমরা একটা পথ দিয়ে যাচ্ছি যার চারিদিকে লাল ফুল। ওই পথের মাঝখানে এসে গাড়ি থামল। পথ থেকেই পাথর দেখা যাচ্ছে। বিশাল এক পাথর। সামনে গিয়ে দেখলাম পাথরের ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা ফাটল। তার পাশেই একটা মন্দির, কিন্তু সেটা তালা দেয়া। বাইরে থেকে কিছু দেখার উপায় নেই। লামার নামটা জানতে চাইলাম। কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। শুধু পাথরের গায়ে একটা মন্ত্র লেখা। “ওম মানি পেদ্মে হুম।”–“পৃথিবীর সব রত্নের সন্ধান মেলে পদ্মের মাঝে।” পদ্মফুলের পাপড়ির বিন্যাসে আছে ভারসাম্য। আর জীবনের ভারসাম্য লুকিয়ে আছে পদ্মের গভীরে ।
আমরা ফিরে আসছি হোটেলের দিকে। পথে পড়ল ভুটানের সবচাইতে দীর্ঘ সাসপেনশন ব্রিজে যাবার রাস্তা। সোনেম গাড়ি পার্ক করল একটা শ্মশানের সামনে। মেঠো পথ ধরে হেঁটে গেলাম আমরা ভিতরের দিকে। একটু উঁচুতে গিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম শ্মশান। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। বিচ্ছিন্ন ভাবে শোকার্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ছবি তুলতে চাইলাম, আমার বাবার কথা মনে পড়লো। মা একটু ধমক দিয়ে বলল এই সব কী দেখে! আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। এবড়োখেবড়ো গ্রামের পথ। দুপুর আড়াইটার করকরে রোদের মধ্যে হেঁটে সাসপেনশন ব্রিজের উপর উঠলাম। লোহার পাত দিয়ে বানানো ঝুলন্ত ব্রিজে দাঁড়িয়ে চোখে পড়ে নানা রঙের পাহাড় আর স্বচ্ছ নীল নদী। নদীর দুই ধারে সাদা পাথর। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন ভাবে লাল কাপড় পরা লামা। এই শহর লামাদের শহর।
ফিরে এলাম হোটেলে। সকালে নদী দেখেছি কিন্তু ঠাণ্ডার জন্য নামতে পারিনি। একবার এই নদীতে না নামলেই না। মা আর আমি স্যান্ডেল পরে প্যান্ট হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে রেডি। নদীর কাছে গিয়ে সাদা বালু পারিয়ে পা পানিতে দেয়া মাত্রই সারা শরীরে হিম বয়ে গেল। উহ কী ঠাণ্ডারে! আমার মন ঠাণ্ডা থেকে উঠে গিয়ে মায়ের পায়ের দিকে স্থির হল। আমার শুধু মনে হচ্ছে মা যদি পড়ে যায়। মহিলার শখ কম না। পানিতে পা ভিজিয়েছে ভাল, কিন্তু সে দেখি আবার আরো গভীরে যায়। মহিলাকে ধমক দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
সূর্য ডুববে ডুববে করছে। আমরা রুমে ফিরে এলাম। আজকে পুনাখায় আমাদের শেষ দিন। আমরা কালকে রওয়ানা হব পারোর দিকে। রুমে এসে খাবার অর্ডার দিলাম। সন্ধ্যার সময়টা কিছুই করার থাকে না পুনাখার মত জায়গায়। চারিদিকে সারাদিন কোনো কোলাহলও নেই যে থামবে আর হঠাৎ করে অনুভব করব সন্ধ্যা নামছে। এ এক অদ্ভুত সন্ধ্যা নামা। নীরবে অন্ধকার নামে পাহাড়ের উপর, মনে হয় যেন বিশালাকৃতি পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে সূর্যকে গ্রাস করে এই সময় আর সন্ধ্যা নেমে গেলে গ্রাস করে অন্ধকার। পাহাড়গুলি সর্বভূক।
১২ ডিসেম্বর ২০১০, খাঙখু
সকালে ঘুম ভাঙল পারো শহরের খাঙখু রিসোর্টে। গতকাল সারাদিন রাস্তায় থেকে বিকালে পৌঁছেছি পারো শহরে। আজকে আমার জন্মদিন। বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে আছি জানালার দিকে। ভুটানে এসে আমি ভাবছি আমার যদি আবার জন্ম হয় তাহলে আমি কী হয়ে জন্মাতে চাই। একবার মনে হল গরু হলে কেমন হয়। ওই যে জানালা দিয়ে দূরে পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আর ওই যে দূরে পাহাড়ের ঢালে নিরীহ গরুরা বিচরণ করছে। পুনর্জন্ম নিয়ে এই ভাবনার গতি-প্রকৃতি আসলে এত বিচিত্র। মা বাইরে থেকে ঘরে এসে আমাকে বলল “হ্যাপি বার্থডে।” আমি ভাবলাম আমি আবার আমার মায়ের মেয়ে হয়েই জন্মাতে চাই।
সকালে নাস্তা করে মা রোদ পোহাল, গোসল করল। আর আমি ওরহান পামুকের ইস্তানবুল বইটা নিয়ে শুয়ে শুয়ে পড়লাম। এগারোটা বাজলে উঠে রেডি হওয়া শুরু করলাম। আজকে ড্রাইভারের নাম তেঞ্জিন। মোটাসোটা খাটো মানুষ। আজকে আমরা যাচ্ছি সোনেম যেখানে আর্চারি খেলছে সেখানে। জায়গাটা পারো শহর থেকে অনেক দূরে একটা পাহাড়ে। আজকে ওইখানে সারাদিনব্যাপী আর্চারি গেমের ম্যাচ হছে। আমরা দুপুরে হোটেল পারোতে দুপুরের লাঞ্চ সেরে তারপর রওনা দিলাম ম্যাচ দেখার উদ্দেশে। গাড়ি সমতলে অনেকদূর গিয়ে তারপর আস্তে আস্তে ওঠা শুরু করলো পাহাড়ে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথের দুই ধারে অনেক দূরে দূরে বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের বসতবাটি। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে ৪ তলা ৫ তলা বিল্ডিং। তেঞ্জিন সোনেমের ভাই। আজকে সোনেম আর্চারি খেলবে বলে তেঞ্জিনকে বলেছে আমাদের নিয়ে ঘুরতে। যাওয়ার পথে তেঞ্জিন আমাদেরকে দেখাল সোনেমের বাড়ি। সোনেমের বাড়ি ৪ তলা। পুরো বিল্ডিংটাই তার।
তেঞ্জিন প্রায় এক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমাদের নিয়ে গেল একটা ব্রিজের কাছে। এখান থেকে আর গাড়ি যায় না। এখান থেকে ঠিক কতদূর হাঁটতে হবে জানি না। আমি ব্রিজ পার হয়ে পাহাড়ের ওপরে ওঠা শুরু করলাম। মাকে রেখে গেলাম ব্রিজের কাছে। এখানের দৃশ্যটা খব সুন্দর। ছোট একটা সাসপেনশন ব্রিজ। এর উপরে উঠে দাঁড়ালে দুই ধারে পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পানি সারাক্ষণ পাথরের গায়ে বাধা পেয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করছে। এই শব্দ আবার পাহাড়ের গায়ে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসছে শো শো করে। পাহাড় আর নদীর এই সহাবস্থান এই জায়গাটিকে একটি বিশেষ পরিবেশ দিয়েছে। সব চাইতে মজার ব্যাপার হল এখানে কোনো টুরিস্ট আসে না। আশেপাশে একটা জীর্ণ দোকান আর দুই একটা বাড়ি দেখে বুঝলাম এখানে টুরিস্টদের আসার কথা নয়।
দূরে দেখা যাচ্ছে গ্রাম। আমি পাথরের ওপর সাবধানে পা রেখে একটু একটু করে উঠতে লাগলাম পাহাড়ের উপর। কিন্তু পথ আর শেষ হয় না যেন। প্রায় ৮০-৯০ মিটার উপরে ওঠার পর আমি বসে পড়লাম একটা পাথরের ওপর। একটু জিরিয়ে আবার ওঠা শুরু করলাম। আরো কিছুদূর গিয়ে দেখি এবার একটা সমতলভূমি। একটা ক্ষেতের চারিদিকে ও মাঝখানে আইল দেয়া। আমি আইল ধরে হাঁটা শুরু করলাম দূরে বাড়িগুলোর দিকে। পথে দেখি দুইটা ৯-১০ বছর বয়সী ছেলে আসছে। আমি তাদেরকে ডেকে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমি আর্চারি গেম যেখানে হচ্ছে সেখানে যেতে চাই। তারা আমার কথা বুঝলো মনে হল কিন্তু ওরা কী কারণে যেন শুধু হাসছে। ওদের হাসি দেখে আমারও হাসি পেল। আমি মনে মনে বলছি “এই শয়তানের বাচ্চা, হাসছিস কেন?” এদিকে আমি এমন একটা জায়গায় আটকে আছি যেখানে গরুর হাম্বা হাম্বা ডাক শোনা যাচ্ছে। আমার মনে হল সবাই আমাকে নিয়ে তামাশা করছে। ছোট ছেলে দুইটা একদিকে, আর অন্য দিকে গরু। এখান থেকে যে যাব কোন দিকে তাও বুঝতে পারছি না। সামনে কোনো রাস্তা দেখা যাচ্ছে না। আমি ডান দিকে গিয়ে একটা বাড়ির উঠানে ঢুকলাম। ডাকাডাকি করলাম “কয়িই হ্যায়?” কোনো মানুষের সাড়াশব্দ তো নেইই তার মধ্যে দেখি উঠানে দুইটা মোরগ মারামারি করছে। এদিকে গোয়াল থেকে গরু সমানে ডেকে চলছে। আমি যখন ভাবছি বাহ কী সুন্দর বিপদ তখন দেখি একটা ছোট শূকরের বাচ্চা আমার দিকে ধেয়ে আসছে। আমি বললাম কাজ সারা। এখন কী হবে! আর শূকরের বাচ্চাটা সামনে আসতেই আমি একটা চিৎকার দিলাম। শূকরের বাচ্চাটা আমাকে দেখে ভয়ে পালালো। আহ কী শান্তি!
এইদিকে কোনো রাস্তা না দেখে আমি উঠান থেকে বের হয়ে বাড়ির পিছনে গেলাম খুঁজতে কোনো রাস্তা আছে কিনা। তখন দেখি বেড়ার পিছন থেকে একটা লোক এসে বেড়ার কাঠ বেয়ে নামলো। তখন বুঝলাম আমাকেও ওই ভাবেই পার হতে হবে। আমি বেড়ার কাঠের খাজের উপর পা রেখে বেড়ার উপর উঠে গেলাম। শয়তান পিচ্চি দুইটা ছেলে আমাকে সাহায্যও করলো না এদিকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি ওদেরকে দূর থেকে হাত দিয়ে মাইর দেয়ার ইশারা করলাম। ওদের একজন তখন আমার কাছে এসে বলে “গিভ মি এ পেন”। আমি বললাম, “ইউ ডিড নট হেল্প মি, অ্যান্ড ইউ ওয়ান্ট এ পেন!–যাহ পেন দিমু না।” ওদেরকে কাচকলা দেখিয়ে আমি বেড়া পার হয়ে হাঁটা শুরু করলাম।
আরো কয়েকটা বাড়ির উঠানের মধ্যে দিয়ে বেড়া পার হয়ে সামনে আবার একটা উঁচু জায়গা দেখা গেল। উঁচু জায়গায় উঠতেই দেখি দূরে দেখা যাচ্ছে আর্চারি খেলোয়াড়দের জটলা। খেলা চলছে। আমাকে দেখে দূর থেকে এগিয়ে আসল সোনেম। সোনেমকে দূর থেকে এগিয়ে আসতে দেখে আমি একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। অনেক লম্বা রাস্তা পার হয়ে এতদূর আসা। খুব পানির পিপাসা পাচ্ছিল। সোনেম আগে থেকেই বুঝতে পারছিল বোধহয় তাই দেখি সে হাতে করে একটা ছোট সাদা বোতল নিয়ে এসেছে। হাতে নিয়ে দেখি সেটা বাংলাদেশ থেকে আসা প্রাণ-এর লিচু জুস। আমার মা কবে যেন বলছিল যে অনেক ছোটবেলায় সে দেখেছিল আমার নানা ভুটান থেকে আমদানি করা জুস খেত। আমার মায়ের ইচ্ছা ছিল সে ভুটানে এসে ওই জুসটা খাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমাকে ভুটানে এসে বাংলাদেশের লিচু জুস খেতে হচ্ছে।
লিচু জুস খেয়ে ঠাণ্ডা হয়ে আমি তীর-ধনুক হাতে নিলাম। বেশ কয়েকবার তীর ছুঁড়ে প্র্যাকটিস করলাম। খেলা চলছে। এক জনের পর আরেকজন তীর ছুড়ছে। কারো তীর টার্গেট পর্যন্ত যাচ্ছে না। এবার এলো সোনেমের পালা। সোনেম ইতিমধ্যে দুইবার টার্গেটে তীর ছুড়তে পেরেছে। তাই তার কোমরে দুইটা রুমাল ঝুলছে। সোনেম যখন তীর-ধনুক হাতে নিল আমি হাতে নিলাম ক্যামেরা। খুব অভিজ্ঞ ভঙ্গিতে সে তীর-ধনুক তাক করল। তীর ছুটে অনেক দূর গেল। আমি দেখতে পারলাম না কোথায়। তার আগেই দেখি অনেক দূর থেকে অন্য পক্ষ চিৎকার করছে। আর তারপরেই শুরু হল সব খেলোয়াড়দের চিৎকার। আমিও আনন্দে বিহবল। সব খেলোয়াড়রা আমাকে এসে বলতে লাগল, “ইউ ব্রট গুড লাক ফর সোনেম।” আমি খুশি হয়ে গেলাম। আর সাথে সাথে দেখি খেলোয়াড়রা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাত ধরে নাচ ও গান শুরু করল একই সাথে। আমার মনে হল আমি ওদের আনন্দের অংশ হয়ে গেলাম। চশমা পড়া একজন আর্চারি খেলোয়াড় আমাকে এসে অভিনন্দন জানালো আর বললো আমার হাত নাকি ভালো, প্র্যাকটিস করলে আমিও টার্গেটে পৌঁছাতে পারবো। শুনে খুশি হলাম কিন্তু মনে খচ খচ করছে মা একা বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। আমাকে যেতে হবে।
প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল গাড়ি পর্যন্ত যেতে। খুব কম করে হলেও প্রায় ১৫০ মিটার উপরে তো উঠেছি । আবারো ঘরবাড়ি, উঠান, ক্ষেত, পাথুরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে হল। গিয়ে দেখি মা শুয়ে আছে গাড়ির সিটে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। অপরাধবোধে মনটা একটু খচ খচ করলো কিন্তু একটু পরে ভাবলাম সারাজীবন মাকে জ্বালিয়েছি, আরেকটু না হয় যন্ত্রনা দিলাম। মাকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম কী করছিল। সে বলল দূর থেকে বসে আমার পাহাড়ে ওঠা দেখছিল। তেঞ্জিন গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়ি ছুটছে পারো শহরের দিকে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে।
আমাদের আজকে ভুটানে শেষ দিন। কালকে সকালে উঠে রওনা দিব ঢাকার উদ্দেশে। কিছু কিনলে আজকেই কিনতে হবে। আমরা তেঞ্জিনকে বললাম আমাদেরকে হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে নিয়ে যেতে। তেঞ্জিন আমাদেরকে নিয়ে এলো একটা রাস্তায় যার দুই ধারে শুধুই হ্যান্ডিক্রাফটের দোকান। আমরা নেমে হাঁটা শুরু করলাম। বেশিক্ষণ নেই হাতে। একটু পরেই আমাদের ফিরতে হবে। আমার নাম ঋতু। আমি কখনোই কিছু না নিয়ে ফিরি না, মরুভূমিতে থাকলে সেখান থেকেও বালু নিয়ে ফেরার মানুষ আমি। মায়ের সাথে দোকানে গিয়ে ছোটবেলার কথা মনে হল — যখন আমি হাঁটতে পারতাম না, আমার মা আমাকে হাতে ধরে শপিং মলে হাঁটত। নস্টালজিয়া আজকে আমাকে কিছু না কিনে ফিরতে দিবে না। আমি কিনলাম ১০০ রুপি দিয়ে একটা পায়ের নূপুর, ২৫০ রুপি দিয়ে এক জোড়া কানের দুল। দেখলাম একধরনের লেবুর রুম স্প্রে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ রুপিতে। আমার মন বলল এটা ভালো হবে। কিনে ফেললাম। একটা হাতে রঙ করা পাথর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। দাম জিজ্ঞেস করে শুনি সেটা ৪০০ রুপি। আমি চলে আসছি দেখে ওই দোকানের এক যুবক আমাকে জিজ্ঞেস করলো কত দিতে চাই। আমি কিছু বললাম না। তখন সে বলল এই পাথরটা তার নিজের হাতে রঙ করা। শিল্পীকে চোখের সামনে দেখে আবার পাথরটার দিকে তাকালাম। প্রথম বারের চাইতেও সুন্দর লাগল দ্বিতীয় বার দেখে। ২০০ রুপিতে দিতে রাজি হল শিল্পী। বললাম “প্যাকেট করে দিন।”
হোটেলে ফিরে আমরা অনেকক্ষণ টিভি দেখলাম বিছানায় শুয়ে শুয়ে। ব্যাগ গুছালাম। আমাদের দীর্ঘ আরামের দিন শেষ হতে যাচ্ছে। মা দেখি বিছানায় সেঁটে শুয়ে আছে। চ্যানেল বদলাতে বদলাতে দেখি একটা ভুটানি চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে একটা মেয়ে বাথরুমে বসে কাঁদছে। কান্নার অভিনয়টা খুব বাস্তব মনে হচ্ছে। আমার মা বলে, “পৃথিবীতে সব দেশেই দেখি মেয়ে মানুষ কান্দে।” মায়ের মন্তব্য শুনে আমি হাসলাম।
১৩ ডিসেম্বর ২০১০
আজকে সকালে উঠে আমরা একটা সুন্দর দেশের পাহাড়দের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। গত কয়েকদিনে শীতে আমাদের যেই কষ্ট হয়েছে তা আমরা দুইজনেই ভুলে যাব দেশে ফিরে গেলে। মনে থাকবে রোদমাখা পাহাড়ের চূড়াগুলো। মাকে দেখলাম আজকে সকালে উঠেও হোটেলের বাইরে কনকনে ঠাণ্ডায় রোদ পোহাচ্ছে। সকালের নাস্তা শেষ করে রেডি হয়ে নিচে নেমে গেলাম। ১১টায় প্লেন ছাড়বে। খাংখু রিসোর্ট থেকে এয়ারপোর্ট দেখা যায়। গতকাল একটা প্লেনও দেখেছিলাম ল্যান্ড করতে। ১০ মিনিট লাগল রিসোর্ট থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। এই দশ মিনিট ধরে রোদে চিক চিক করা নদীর পানির দিকে চেয়ে থাকলাম। গাড়ি থেকে নদীর বয়ে যাওয়ার শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু আমার মনে হলো আমি একটা ছল ছল শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আর এই শব্দটা সাথে নিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন