থাইল্যাণ্ডে এসেছি গত মাসের শেষের দিকে। সারাদিন ট্রেনিংয়ের শেষে সন্ধ্যা
বেলায় আমরা মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হই। গত দুই দিন ধরে চেংমাই ঘুরে দেখলাম।
আমরা মোট দশজন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছি এই কোর্স করতে। মজার ব্যাপার হল দশজন ছেলেমেয়ে এসেছে দশটা দেশ থেকে। তাই cross-cultural communication করতে গিয়ে ভারি মজার মজার সব ঘটনা ঘটছে। সবার যোগাযোগের কমন ভাষা ইংরেজি । তবু সবারই আগ্রহ অন্য ভাষার দু একটা শব্দ শিখে নেওয়া্র ব্যাপারে। কোন বন্ধু যেন নিজেকে দলছুট বা একা না ভাবে, সে ব্যাপারে শিক্ষকসহ সবারই সমান খেয়াল।
কিগ্যান নামে এক শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান ছেলে যেই টের পেল যে আমি রাস্তাঘাট চিনি না, অমনি সে সবাইকে ছেড়ে আমার সাথে হাটতে হাটতে চলে এল আমার সাথে। পুরোটা পথ হাটতে হাটতে আমাকে রাস্তা চেনানোর জন্য অসংখ্য চিহ্ন মুখস্থ করাল। ওর দুটো ক্যামেরা আছে বলে আমাকে একটা দিয়ে রেখেছে যাতে আমি সেটা দিয়ে ইচ্ছেমত ছবি তুলতে পারি কারণ আমার ক্যামেরাটা ডিএসএল আর নয় এবং তা দিয়ে ফুল মেনু কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আর যে গার্লস হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানকার মেয়েগুলোও ভীষণ ভাল।
এবার আসা যাক, থাইল্যাণ্ডের জীবন যাত্রা সম্পর্কে। দুই সপ্তাহয় আমি তেমন একটা ঘোরার সময় পাই নি। আমি যে এলাকাটায় থাকি সেটার নাম চেত ইয়োদ। পাশেই একটা মন্দির আছে এই নামে। সেই মন্দিরের নামেই নামকরণ। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে আসতে বিশ মিনিট লাগে। জায়গাটা সুপার হাইওয়ের এক পাশে।
বেশ মফ:স্বল মফ:স্বল ভাব আছে জায়গাটায়। কারণ জায়গাটা খুব ফাকা আর নিরিবিলি। বেশিরভাগ মানুষই স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য বাইক চালায়। যাদের বাইক নেই, তারা প্রায় ১৫ মিনিট পায়ে হেটে হার্বারে যায়। সেখান থেকে 'সং তাও' নামে এক রকমের যান পাওয়া যায়- বাহনটা আমাদের দেশের টেম্পোর থাই সংস্করণ আর কি। এছাড়াও আছে টুকটুক- বাংলাদেশের রিকশার মতই অনেকটা। তবে আমাদের রিকশার মত অত সুলভ নয় জিনিসটা। যে যানবাহনই নিতে চান না কেন, আপনাকে হার্বারে বা কোন বড় রাস্তার সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে। আমাদের দেশে যেমন বাসার গেট খুলেই 'এই রিকশা' বলে হাক দিয়ে রিকশা দাড় করে ফেলা যায়, এখানে সে উপায় নেই।
একা চলাচলের ব্যাপারে আমার এখনো তেমন কনফিডেন্স আসে নি কারণ আমি থাই বলতে পারি না আর ওরা থাই ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। ইংরেজি বলা তো দুরের কথা, বোঝেও না। তাই দু একটা ছোটখাট কেনাকাটার জন্য আমি কয়েক পা দূরের সেভেন/ইলেভেন স্টোর ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার ঝুকি নিই না। অন্য কোথাও ঘুরতে গেলে দল বেধে যাই।
তবে থাইরা খুবই হাসিখুশি।এমনকি রাগ প্রকাশের জন্যও ওদের বিশেষ রকমের হাসি আছে। আপনাকে দেখলেই চিনুক না চিনুক, চোখাচোখি হওয়া মাত্রই 'সোওয়াদিখা/সোওয়াদিখাপ' বলে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানাবে। মেয়েরা বলে 'সোওয়াদিখা' আর ছেলেরা বলে 'সোওয়াদিখাপ'। অচেনা মানুষকে এভাবে স্বাগত জানানোর ব্যাপারটা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে।
পোশাক আশাকের ব্যাপারে পশ্চিমাদের সাথে তেমন একটা পার্থক্য আমার চোখে ধরা পড়ছে না।কখনো কখনো আমার বয়সী মেয়েদের পোশাক আশঙ্কাজনক রকমের সংক্ষিপ্ত।আমার সাথে থাকা পশ্চিমা রুমমেটদেরও হার মানায়।
বার আর ক্যাফের ব্যাপারে আমি রীতিমত লা-জওয়াব। রাস্তার পাশের খাবারগুলোর স্বাদ অসাধারণ। দামেও সস্তা। একটা সসেজ কিংবা বেকড ব্যানানা কিনতে লাগছে ১০ বাথ।বেকড্ ব্যানানা! শুনতে অদ্ভূত লাগছে না? কিন্তু স্বাদটা অসাধারণ! পকেটে টাকা একটু বেশি থাকলে ঢুকে পড়া যায় কোন ক্যাফে তে। ওখানে কফির ধরণ বুঝে দাম। তবে এক কাপ ল্যাটে পাওয়া যায় ৫০-৬০ বাথের মধ্যে। দামটা আমার কাছে মোটামুটি সস্তাই মনে হল।এখনো স্টারবাক্সে যাওয়া হয় নি।আমাদের কারোরই অত ট্যাকের জোর নেই কিনা।
তবে জেনে রাখা ভাল যে, আপনি যদি রবিবারে চেংমাইয়ের ধারে কাছে থাকেন তবে নাইট বাজারটা ঘুরে আসতে পারেন। দারুণ দারুণ জিনিস পাবেন ওখানে। তবে দামাদামি করতে হবে।
অনেকক্ষণ বকবক করলাম। বিদায় নিই আপাতত। ঘড়িতে বারটা বেজে গেছে। যাওয়ার আগে বলি, কাপখুন খাআআআ (ধন্যবাদ)।
ওই যে বলে না--- দাগ থেকে যদি ভাল কিছু হয়, তবে দাগ ভাল। ঠিক সেই রকম, আমার আহাম্মকি থেকে যদি কৌতুকের জন্ম হয়, তবে আহাম্মকিই ভাল।
হেঁয়ালী না করে ব্যাপারটা খুলে বলি।কাল আমাদের সবগুলো সেশন ছিল ফাইনাল কাট প্রো-এর উপরে। দশজনের মধ্যে সাতজনেরই এডিটিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এবং ওরা সাতজনই ঈর্ষণীয় একেকটা ম্যাক ল্যাপটপের মালিক। তো, আমরা যারা এডিটিংয়ে এক্কবারে আনাড়ি তাদেরকে ওই সাতজনের সাথে একসাথে মিশিয়ে বসানো হল। আর আমাদের- মানে যাদের ম্যাক ল্যাপটপ নেই তাদের জন্য একটা করে আইম্যাক দেওয়া হল।
আমার পাশে বসল রিচার্ড। ছেলেটা জন্মসূত্রে আমেরিকান। কিন্তু থাইল্যাণ্ডে বড় হয়েছে বলে মন মানসিকতা এবং মূল্যবোধ এশিয়ানদের মত। ও নিজেকে থাই হিসেবেই পরিচয় দেয়- যদিও থাই সরকারের চোখে সে নিছকই বিদেশী।
ওকে পাশে পেয়ে আমি খুশিই হলাম। কারণ ওর সাথে আমার খুব জমে। কিন্তু তখন কি আর জানি ও আজ আমার মান-সম্মান নিয়ে 'অপু দশ বিশ' খেলবে!
যাহোক, আমাদের কানেডিয়ান শিক্ষক বললেন, তিন চার লাইনের একটা স্ক্রিপ্ট দিয়ে ছোটখাট একটা মক শুটিং করে ফেলতে। ৩০ মিনিটের মধ্যে শুটিং শেষ করতে হবে।রব নামের এক আমেরিকান এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল পরিচালনা করার জন্য। কিন্ত এবারই বাধল আসল বিপত্তি। শিক্ষক শর্ত জুড়ে দিলেন।বললেন-এমন দুজনকে দিয়ে অভিনয় করাতে হবে যারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় যোগাযোগ করতে সক্ষম। আর সেই ভাষাটা হতে হবে পরিচালকের অজানা। উনি দেখতে চান, অনুবাদকের উপর ভর করে পরিচালক Cross cultural situation মোকাবেলা করতে কতটা সক্ষম।
রব তো ভেবে পায় না, কাদের দিয়ে অভিনয় করাবে। ফস করে রিচার্ড বলে বসল, "শ্যামা আর ওয়াসিম। ওয়াসিম পাকিস্তানী, ও উর্দু বলে আর শ্যামাও ভালই উর্দু বোঝে। ওরাই অভিনয় করুক।"
আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ছেলে মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করালে নিশ্চয় রোমান্স করাবে! হ্যা, আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। পরিচালক রব আমাকে সিন দুটো বুঝিয়ে দিল।হাত ধরাধরির কোন ব্যাপার নেই। কেবল দুই লাইন ডায়ালগ। খুবই সিম্পল। তবু আমি এদের কী করে বোঝাব, আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারি, মজা করতে পারি। কিন্তু আমি এসব পারি না! মানুষের সামনে অভিনয় করতে গেলে আমার ভীষণ আড়ষ্ট লাগে। কিন্তু এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আপত্তি করলে ওরা সবাই হয়তো আমাকে খুব সংকীর্ণ ভাববে! আর রব এবং শিক্ষককে আমি খুব সম্মান করি।আমি ছাড়া আর কেউ তো উর্দু বা হিন্দি বুঝবে না।
চুপ করে বসে থাকলাম। সবাই মহাসমারোহে ক্যামেরা, বুম, লাইট সেট করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎই রিচার্ড ভীড় ঠেলে এসে আমার পাশে বসল। ও বুঝে গেছে, খবর খারাপ! বলল, "Are you okay, Shyama?"
থমথমে মুখে বললাম, "No. I'm not."
ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "I'm such an idiot!"
ওর অনুতপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর অনুতাপে কোন খাদ নেই। হেসে বললাম, "ইয়েস, ইউ আর।" ও হেসে উঠল। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। একটু পরে রব এসে আমার সাথে কথা বলল। আমাকে জিজ্ঞেস না করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে দু:খ প্রকাশ করল।
কিন্তু প্যাচটা লাগল কাস্টিং নিয়ে। মেয়েরা কেউই উর্দু বা হিন্দি পারে না। এখন ওদেরকে ডায়ালগ মুখস্থ করাতেই সময় পার হয়ে যাবে। কিন্তু রিচার্ড চাইছে না, চাপে পড়ে আমি আর এ ব্যাপারে মাথা গলাই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও বলে উঠল, "আরে বাদ দাও, আমিই পারব! মাত্র তো কয়টা লাইন। আমিই হব ওয়াসিমের প্রেমিকা্।"
সবাই তো হা। কয়েকজন বলে উঠল, "তা কী করে হয়? একে তুই ছেলে, তার উপরে জীবনে কোনদিন উর্দু, হিন্দীর ধারেকাছে ছিলি না।"
ও কিন্তু সিরিয়াস। সোজা আমার পাশে এসে বসল। লাইনগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করল কিন্তু হিন্দী মুখস্থ করা কি চারটি খানি কথা? তাও আবার জিভ যদি হয় আমেরিকান! বুঝতেই পারছেন পাঠক, উচ্চারণের কী হাল হয়েছিল। যাই হোক, ও ঠিক করল, ডায়ালগ লেখা নোটবুকটা হাতে নিয়েই অভিনয় করবে।
শুটিংয়ের সময় সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।নিজের দাড়িওয়াআলা মুখ নিয়ে এত সুন্দর করে ও মেয়ের গলা করছে যা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নি, আর অঙ্গ ভঙ্গীও ভীষণ হাস্যকর। আমি লক্ষ্য করলাম, ও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে, মজাও পাচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় ওর পুরো মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা ডায়ালগের পর।
শুটিং শেষে পরিচালক রব বলল, " আমার জীবনে দেখা সেরা দাড়িওয়ালা নায়িকা তুমি।"
প্যাক আপ হয়ে গেলে, ও আমার কাছ থেকে কলম চেয়ে নিয়ে আমার নোটবুকে কী যেন লিখতে লাগল। ওর মুখে চাপা হাসি।
নোটবুকটা ফিরে পেয়ে দেখলাম, তাতে লেখা-- "মনে রেখো, আজ রিচার্ড তোমার জীবন বাচিয়েছে।"
লিখেছেনঃ চিত্রাঙ্গদা (তারিখঃ বৃহঃ, ০৫/০৯/২০১৩ - ১১:১৮)
আমরা মোট দশজন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়েছি এই কোর্স করতে। মজার ব্যাপার হল দশজন ছেলেমেয়ে এসেছে দশটা দেশ থেকে। তাই cross-cultural communication করতে গিয়ে ভারি মজার মজার সব ঘটনা ঘটছে। সবার যোগাযোগের কমন ভাষা ইংরেজি । তবু সবারই আগ্রহ অন্য ভাষার দু একটা শব্দ শিখে নেওয়া্র ব্যাপারে। কোন বন্ধু যেন নিজেকে দলছুট বা একা না ভাবে, সে ব্যাপারে শিক্ষকসহ সবারই সমান খেয়াল।
কিগ্যান নামে এক শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান ছেলে যেই টের পেল যে আমি রাস্তাঘাট চিনি না, অমনি সে সবাইকে ছেড়ে আমার সাথে হাটতে হাটতে চলে এল আমার সাথে। পুরোটা পথ হাটতে হাটতে আমাকে রাস্তা চেনানোর জন্য অসংখ্য চিহ্ন মুখস্থ করাল। ওর দুটো ক্যামেরা আছে বলে আমাকে একটা দিয়ে রেখেছে যাতে আমি সেটা দিয়ে ইচ্ছেমত ছবি তুলতে পারি কারণ আমার ক্যামেরাটা ডিএসএল আর নয় এবং তা দিয়ে ফুল মেনু কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে নানাভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। আর যে গার্লস হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে সেখানকার মেয়েগুলোও ভীষণ ভাল।
এবার আসা যাক, থাইল্যাণ্ডের জীবন যাত্রা সম্পর্কে। দুই সপ্তাহয় আমি তেমন একটা ঘোরার সময় পাই নি। আমি যে এলাকাটায় থাকি সেটার নাম চেত ইয়োদ। পাশেই একটা মন্দির আছে এই নামে। সেই মন্দিরের নামেই নামকরণ। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়িতে করে আসতে বিশ মিনিট লাগে। জায়গাটা সুপার হাইওয়ের এক পাশে।
বেশ মফ:স্বল মফ:স্বল ভাব আছে জায়গাটায়। কারণ জায়গাটা খুব ফাকা আর নিরিবিলি। বেশিরভাগ মানুষই স্বাধীনভাবে চলাচলের জন্য বাইক চালায়। যাদের বাইক নেই, তারা প্রায় ১৫ মিনিট পায়ে হেটে হার্বারে যায়। সেখান থেকে 'সং তাও' নামে এক রকমের যান পাওয়া যায়- বাহনটা আমাদের দেশের টেম্পোর থাই সংস্করণ আর কি। এছাড়াও আছে টুকটুক- বাংলাদেশের রিকশার মতই অনেকটা। তবে আমাদের রিকশার মত অত সুলভ নয় জিনিসটা। যে যানবাহনই নিতে চান না কেন, আপনাকে হার্বারে বা কোন বড় রাস্তার সামনে গিয়ে দাড়াতে হবে। আমাদের দেশে যেমন বাসার গেট খুলেই 'এই রিকশা' বলে হাক দিয়ে রিকশা দাড় করে ফেলা যায়, এখানে সে উপায় নেই।
একা চলাচলের ব্যাপারে আমার এখনো তেমন কনফিডেন্স আসে নি কারণ আমি থাই বলতে পারি না আর ওরা থাই ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। ইংরেজি বলা তো দুরের কথা, বোঝেও না। তাই দু একটা ছোটখাট কেনাকাটার জন্য আমি কয়েক পা দূরের সেভেন/ইলেভেন স্টোর ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার ঝুকি নিই না। অন্য কোথাও ঘুরতে গেলে দল বেধে যাই।
তবে থাইরা খুবই হাসিখুশি।এমনকি রাগ প্রকাশের জন্যও ওদের বিশেষ রকমের হাসি আছে। আপনাকে দেখলেই চিনুক না চিনুক, চোখাচোখি হওয়া মাত্রই 'সোওয়াদিখা/সোওয়াদিখাপ' বলে হাত জোড় করে মাথা নুইয়ে স্বাগত জানাবে। মেয়েরা বলে 'সোওয়াদিখা' আর ছেলেরা বলে 'সোওয়াদিখাপ'। অচেনা মানুষকে এভাবে স্বাগত জানানোর ব্যাপারটা আমাকে বেশ মুগ্ধ করেছে।
পোশাক আশাকের ব্যাপারে পশ্চিমাদের সাথে তেমন একটা পার্থক্য আমার চোখে ধরা পড়ছে না।কখনো কখনো আমার বয়সী মেয়েদের পোশাক আশঙ্কাজনক রকমের সংক্ষিপ্ত।আমার সাথে থাকা পশ্চিমা রুমমেটদেরও হার মানায়।
বার আর ক্যাফের ব্যাপারে আমি রীতিমত লা-জওয়াব। রাস্তার পাশের খাবারগুলোর স্বাদ অসাধারণ। দামেও সস্তা। একটা সসেজ কিংবা বেকড ব্যানানা কিনতে লাগছে ১০ বাথ।বেকড্ ব্যানানা! শুনতে অদ্ভূত লাগছে না? কিন্তু স্বাদটা অসাধারণ! পকেটে টাকা একটু বেশি থাকলে ঢুকে পড়া যায় কোন ক্যাফে তে। ওখানে কফির ধরণ বুঝে দাম। তবে এক কাপ ল্যাটে পাওয়া যায় ৫০-৬০ বাথের মধ্যে। দামটা আমার কাছে মোটামুটি সস্তাই মনে হল।এখনো স্টারবাক্সে যাওয়া হয় নি।আমাদের কারোরই অত ট্যাকের জোর নেই কিনা।
তবে জেনে রাখা ভাল যে, আপনি যদি রবিবারে চেংমাইয়ের ধারে কাছে থাকেন তবে নাইট বাজারটা ঘুরে আসতে পারেন। দারুণ দারুণ জিনিস পাবেন ওখানে। তবে দামাদামি করতে হবে।
অনেকক্ষণ বকবক করলাম। বিদায় নিই আপাতত। ঘড়িতে বারটা বেজে গেছে। যাওয়ার আগে বলি, কাপখুন খাআআআ (ধন্যবাদ)।
ওই যে বলে না--- দাগ থেকে যদি ভাল কিছু হয়, তবে দাগ ভাল। ঠিক সেই রকম, আমার আহাম্মকি থেকে যদি কৌতুকের জন্ম হয়, তবে আহাম্মকিই ভাল।
হেঁয়ালী না করে ব্যাপারটা খুলে বলি।কাল আমাদের সবগুলো সেশন ছিল ফাইনাল কাট প্রো-এর উপরে। দশজনের মধ্যে সাতজনেরই এডিটিংয়ের অভিজ্ঞতা আছে এবং ওরা সাতজনই ঈর্ষণীয় একেকটা ম্যাক ল্যাপটপের মালিক। তো, আমরা যারা এডিটিংয়ে এক্কবারে আনাড়ি তাদেরকে ওই সাতজনের সাথে একসাথে মিশিয়ে বসানো হল। আর আমাদের- মানে যাদের ম্যাক ল্যাপটপ নেই তাদের জন্য একটা করে আইম্যাক দেওয়া হল।
আমার পাশে বসল রিচার্ড। ছেলেটা জন্মসূত্রে আমেরিকান। কিন্তু থাইল্যাণ্ডে বড় হয়েছে বলে মন মানসিকতা এবং মূল্যবোধ এশিয়ানদের মত। ও নিজেকে থাই হিসেবেই পরিচয় দেয়- যদিও থাই সরকারের চোখে সে নিছকই বিদেশী।
ওকে পাশে পেয়ে আমি খুশিই হলাম। কারণ ওর সাথে আমার খুব জমে। কিন্তু তখন কি আর জানি ও আজ আমার মান-সম্মান নিয়ে 'অপু দশ বিশ' খেলবে!
যাহোক, আমাদের কানেডিয়ান শিক্ষক বললেন, তিন চার লাইনের একটা স্ক্রিপ্ট দিয়ে ছোটখাট একটা মক শুটিং করে ফেলতে। ৩০ মিনিটের মধ্যে শুটিং শেষ করতে হবে।রব নামের এক আমেরিকান এক পায়ে খাড়া হয়ে গেল পরিচালনা করার জন্য। কিন্ত এবারই বাধল আসল বিপত্তি। শিক্ষক শর্ত জুড়ে দিলেন।বললেন-এমন দুজনকে দিয়ে অভিনয় করাতে হবে যারা ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় যোগাযোগ করতে সক্ষম। আর সেই ভাষাটা হতে হবে পরিচালকের অজানা। উনি দেখতে চান, অনুবাদকের উপর ভর করে পরিচালক Cross cultural situation মোকাবেলা করতে কতটা সক্ষম।
রব তো ভেবে পায় না, কাদের দিয়ে অভিনয় করাবে। ফস করে রিচার্ড বলে বসল, "শ্যামা আর ওয়াসিম। ওয়াসিম পাকিস্তানী, ও উর্দু বলে আর শ্যামাও ভালই উর্দু বোঝে। ওরাই অভিনয় করুক।"
আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ছেলে মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করালে নিশ্চয় রোমান্স করাবে! হ্যা, আমার আশঙ্কাই সত্যি হল। পরিচালক রব আমাকে সিন দুটো বুঝিয়ে দিল।হাত ধরাধরির কোন ব্যাপার নেই। কেবল দুই লাইন ডায়ালগ। খুবই সিম্পল। তবু আমি এদের কী করে বোঝাব, আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারি, মজা করতে পারি। কিন্তু আমি এসব পারি না! মানুষের সামনে অভিনয় করতে গেলে আমার ভীষণ আড়ষ্ট লাগে। কিন্তু এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আপত্তি করলে ওরা সবাই হয়তো আমাকে খুব সংকীর্ণ ভাববে! আর রব এবং শিক্ষককে আমি খুব সম্মান করি।আমি ছাড়া আর কেউ তো উর্দু বা হিন্দি বুঝবে না।
চুপ করে বসে থাকলাম। সবাই মহাসমারোহে ক্যামেরা, বুম, লাইট সেট করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎই রিচার্ড ভীড় ঠেলে এসে আমার পাশে বসল। ও বুঝে গেছে, খবর খারাপ! বলল, "Are you okay, Shyama?"
থমথমে মুখে বললাম, "No. I'm not."
ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "I'm such an idiot!"
ওর অনুতপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, ওর অনুতাপে কোন খাদ নেই। হেসে বললাম, "ইয়েস, ইউ আর।" ও হেসে উঠল। তারপর আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল। একটু পরে রব এসে আমার সাথে কথা বলল। আমাকে জিজ্ঞেস না করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে দু:খ প্রকাশ করল।
কিন্তু প্যাচটা লাগল কাস্টিং নিয়ে। মেয়েরা কেউই উর্দু বা হিন্দি পারে না। এখন ওদেরকে ডায়ালগ মুখস্থ করাতেই সময় পার হয়ে যাবে। কিন্তু রিচার্ড চাইছে না, চাপে পড়ে আমি আর এ ব্যাপারে মাথা গলাই। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ও বলে উঠল, "আরে বাদ দাও, আমিই পারব! মাত্র তো কয়টা লাইন। আমিই হব ওয়াসিমের প্রেমিকা্।"
সবাই তো হা। কয়েকজন বলে উঠল, "তা কী করে হয়? একে তুই ছেলে, তার উপরে জীবনে কোনদিন উর্দু, হিন্দীর ধারেকাছে ছিলি না।"
ও কিন্তু সিরিয়াস। সোজা আমার পাশে এসে বসল। লাইনগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করল কিন্তু হিন্দী মুখস্থ করা কি চারটি খানি কথা? তাও আবার জিভ যদি হয় আমেরিকান! বুঝতেই পারছেন পাঠক, উচ্চারণের কী হাল হয়েছিল। যাই হোক, ও ঠিক করল, ডায়ালগ লেখা নোটবুকটা হাতে নিয়েই অভিনয় করবে।
শুটিংয়ের সময় সবাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।নিজের দাড়িওয়াআলা মুখ নিয়ে এত সুন্দর করে ও মেয়ের গলা করছে যা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি নি, আর অঙ্গ ভঙ্গীও ভীষণ হাস্যকর। আমি লক্ষ্য করলাম, ও অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে, মজাও পাচ্ছে, কিন্তু লজ্জায় ওর পুরো মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা ডায়ালগের পর।
শুটিং শেষে পরিচালক রব বলল, " আমার জীবনে দেখা সেরা দাড়িওয়ালা নায়িকা তুমি।"
প্যাক আপ হয়ে গেলে, ও আমার কাছ থেকে কলম চেয়ে নিয়ে আমার নোটবুকে কী যেন লিখতে লাগল। ওর মুখে চাপা হাসি।
নোটবুকটা ফিরে পেয়ে দেখলাম, তাতে লেখা-- "মনে রেখো, আজ রিচার্ড তোমার জীবন বাচিয়েছে।"
লিখেছেনঃ চিত্রাঙ্গদা (তারিখঃ বৃহঃ, ০৫/০৯/২০১৩ - ১১:১৮)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন