
নির্ধারিত সময়ের ২০ মিনিট আগেই লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি ওয়াশিংটন ডিসি’র ডালাস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছল। রানওয়েতে বিমানের চাকা স্পর্শ করার পর পাইলট একটু হেসে বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে এ তথ্য বন্ধুবান্ধবদের সাথে শেয়ার করার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করলেন।
বিমানবন্দরে নেমে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় মনে পড়ল ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার কথা। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ইমিগ্রেশন পার হতে তোমার ১৫ মিনিট লাগতে পারে, আবার ২ ঘণ্টাও লাগতে পারে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ধৈর্য হারাবে না। যা প্রশ্ন করা হবে স্পষ্টভাবে সরাসরি উত্তর দেবে’।
কালো পোশাক পরা কৃষ্ণ বর্ণের ইমিগ্রেশন অফিসার অবশ্য আমাকে খুব একটা প্রশ্ন করল না। শুধু দূতাবাস থেকে দেয়া একটি বিশেষ চিঠি দেখতে চাইল। ১৫ মিনিটেই ইমিগ্রেশন পার হয়ে লাগেজ সংগ্রহের জন্য কনভেয়ার বেল্টের কাছে চলে এলাম। কাস্টমস পার হয়ে যখন লাউঞ্জে পৌঁছালাম দেখলাম আমার নাম লেখা প্লাকার্ড নিয়ে কৃষ্ণ বর্ণের একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। নিশ্চিত হলাম ইনিই হচ্ছেন আমাদের প্রোগ্রামের লিয়াজোঁ অফিসার বারবারা।
ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর্স লিডারশিপ প্রোগ্রামে (আইভিএলপি) অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র এসেছি। নয়া দিগন্তের কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে আমার পাশাপাশি নিউ এইজের একজন সাংবাদিককে নির্বাচন করেছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস। এ প্রোগ্রামে ভারতের তিনজন, পাকিস্তানের দু’জন এবং শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের একজন করে প্রতিনিধি অংশ নেন। এয়ারপোর্টে পাকিস্তানি দুই মহিলার সাথে পরিচয় হলো। বাকিদের সাথে হলো হোটেলে।
বিমানবন্দরের বাইরে পা রেখে দেখলাম আবহাওয়াটা আরামদায়ক, হয়তো ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। ঢাকায় তখন জুনের ভ্যাপসা গরম চলছে। বারবারা আমাদের একটি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে চলে যেতে বলল। কেননা বাকিদের জন্য তাকে এয়ারপোর্টে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। ট্যাক্সি হিসেবে যেটাতে চড়লাম সেটা একটা ফোর হুইলার। এটি জিপ হিসেবে আমাদের দেশে সমধিক পরিচিত, যদিও জিপ একটি জনপ্রিয় ফোর হুইলার ব্র্যান্ডের নাম। আইভিএলপি’র জন্য দেয়া প্রস্তুতিমূলক কাগজপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল যে আমেরিকায় ট্যাক্সি ও রেস্টুরেন্টে বিলের ওপর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ টিপস হিসেবে দেয়ার রেওয়াজ চালু আছে। হোটেলে যখন পৌঁছলাম মিটারে এলো ৫৮ ডলার। টিপসের বিষয়টি সঠিক কি না পরীক্ষা করার জন্য ট্যাক্সিচালককে দিলাম ৬০ ডলার। সাথে সাথে বিশালদেহী কৃষ্ণ বর্ণের লোকটি প্রতিবাদ করে স্পষ্ট বলল, ‘তুমি আমাকে মাত্র দুই ডলার টিপস দিচ্ছো’। দেরি না করে তাড়াতাড়ি তাকে একটি পাঁচ ডলারের নোট বের করে বিদায় দিলাম।
ঢাকা থেকে প্রায় ২৭ ঘণ্টার টানা যাত্রার পর ক্লান্তি আসাটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাতের খাবারের জন্য একটি সুবিধাজনক রেস্টুরেন্ট এবং ইন্টারন্যাশনাল ফোনকার্ডসহ প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র কেনার জন্য হোটেলের আশপাশে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুঁজে বের করাটা জরুরি ছিল। হোটেলের রিসিপশনে জিজ্ঞেস করলে একজন একটি পথ দেখিয়ে সিভিএস ফার্মেসির কথা জানাল যে এ পথে কয়েকটি রেস্টুরেন্টও আছে। ফার্মেসির কথা শুনে প্রথম মনে হলো এখানে শুধু ওষুধপত্র পাওয়া যাবে। পরে দেখলাম এটা আমাদের নন্দন বা আগোরার মতোই বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। সিভিএস ফার্মেসি একটি চেইন স্টোর, আমেরিকার বিভিন্ন শহরে এর অনেক শাখা রয়েছে।
আমেরিকায় আমার প্রথম দিনে একটা মজার অভিজ্ঞতা হলো। দেখলাম রাত ৯টা পর্যন্ত এখানে দিনের আলো আছে। গ্রীষ্মে এখানে সন্ধ্যা হয় রাত ৯টায়, আর আমাদের দেশে ৭টা। তবে রাতের খাবারের জন্য ওয়াশিংটনের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ভিড় জমতে শুরু করে ৭টা থেকেই। আর তা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। আমেরিকানরা রাতের পানাহারকে বেশ উপভোগ করে। রেস্টুরেন্টগুলোতেও থাকে রকমারি ব্যবস্থা।
দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি কাটিয়ে ওঠার জন্য পর দিন আমাদের কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি। শুধু শহর ঘুরে দেখার জন্য একটি সিটি ট্যুরের ব্যবস্থা ছিল। রাজধানী করার বিষয়টি মাথায় রেখেই ওয়াশিংটনকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। অল্প দূরত্বের মধ্যেই হোয়াইট হাউস (প্রেসিডেন্টের কার্যালয়), ক্যাপিটাল বিল্ডিং (সংসদ), স্টেট ডিপার্টমেন্ট (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), পেন্টাগন (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়), এফবিআই, সিআইএ, হোমল্যান্ড সিকিউরিটিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব সরকারি কার্যালয়। ফলে সরকারি কাজের জন্য বিভিন্ন বিভাগে ছুটাছুটিটা দ্রুত ও দক্ষতার সাথে করা যায়। পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে ওয়াশিংটনে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতার বেশি ভবন তৈরি করতে দেয়া হয় না। এ ছাড়া ভবনের নকশায় পুরনো ঐতিহ্যকে যতেœর সাথে লালন করা হয়।
সিটি ট্যুরের প্রথমেই গেলাম হোয়াইট হাউসে। গ্রিলঘেরা সীমানা প্রাচীর দিয়ে ভবনটা পরিষ্কার দেখা যায়। নিরাপত্তার কড়াকড়িটা বাইরে থেকে চোখে পড়ে না। শুধু দেখালাম দু’টি পুলিশের গাড়ি ইঞ্জিন চালু অবস্থায় প্রাচীরের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটকরা সীমানা প্রাচীরের কাছে দাঁড়িয়েই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ভবনকে পেছনে রেখে ছবি তুলছে। তবে আমি নিশ্চিত কোনো না কোনোভাবে ভবনটির নিñিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের সীমানা প্রাচীরের ঠিক সামনেই এক বৃদ্ধাকে দেখলাম ঝুপরির মধ্যে বসে আছে। কৌতূহল নিয়ে গেলাম তার কাছে। পিচিয়োটো নামের মহিলাটি জানাল বিশ্বব্যাপী মার্কিন সরকারের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির তৎপরতার প্রতিবাদে ১৯৮১ সাল থেকেই তিনি এখানে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে বহুবার তাকে উচ্ছেদের চেষ্টা চালানো হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে, কিন্তু তিনি দমেননি। ঝড়-বৃষ্টি, তুষারপাত উপেক্ষা করে তিনি প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন। বিভিন্ন সময়ে এ বৃদ্ধা হোয়াইট হাউসের প্রাচীরেই মেড হাউস বা পাগলের ঘর লেখা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন।
আমরা যখন ক্যাপিটল বিল্ডিংয়ে পৌঁছলাম তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এ বৃষ্টির মধ্যেও একদল লোক প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে সরকারের কোনো নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পর্যটকরা বৃষ্টি উপেক্ষা করে রেইনকোট গায়ে চাপিয়ে ছবি তুলছে।
স্কুলগুলোতে তখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছিল। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে সিনেট অফিস বিল্ডিং ঘুরে দেখছিল। আমরাও একটি গ্রুপে গাইডের পেছনে পেছনে বিশাল ভবনটি ঘুরে দেখলাম। ভবনের বিভিন্ন অংশের মধ্যে চলাচল দ্রুত করার জন্য এক ধরনের মিনি ট্রেন ব্যবহার করা হয়। ভবন ঘুরতে ঘুরতে ভাবলাম আমাদের দেশের সংসদ পরিদর্শনের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা কি আছে? বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশের সংসদ ভবন পরিদর্শনে যদি নিরাপত্তার সমস্যা না হয়, তবে আমাদের সমস্যাটা কোথায়। গত বছর লন্ডন সফরকালে হাউস অব লর্ডসের সভাকক্ষের গ্যালারিতে বসে অন্য পর্যটকদের পাশাপাশি সংসদের কার্যক্রমও পরিদর্শন করেছি।
আইভিএলপি’র টিম হিসেবে পেন্টাগন পরিদর্শনের একটি দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক মার্কিন সামরিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু এ পেন্টাগন। দৈত্যাকৃতির এ ভবনটির নকশা অদ্ভুত। গোলাকার ভবনের ঠিক মধ্যখানে রয়েছে একটি ফাঁকা জায়গা। এই ফাঁকা জায়গায় কোনো ছাদ নেই। লোকজন সূর্যের আলো পোহাতে বা ধূমপান করতে এখানে এসে থাকে। এ ছাড়া জায়গাটি ভবনের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যেতে শর্টকার্ট প্যাসেজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভবনটির বাইরে পার্কিংয়ে কয়েক হাজার গাড়ি রাখা আছে। পেন্টাগনের কর্মকর্তারাও স্বীকার করলেন যে, এ বিশাল পার্কিংয়ে নিজের গাড়ি খুঁজে পেতে তাদেরও মাঝে মধ্যে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়।
কঠোর নিরাপত্তা পার হয়ে মূল ভবনে প্রবেশ করার পর দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন সামরিক নীতি সম্পর্কে আমাদের একটি ব্রিফিং দেয়া হলো। এরপর সামরিক বাহিনীর একজন তরুণ গাইড পেন্টাগন ভবন ঘুরে দেখাল। তরুণ সেনা আমাদের কোনো প্রকার ছবি না তোলা এবং দল থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার জন্য সতর্ক করে দিলো। প্রায় ৩০ মিনিটের এ গাইডেড ট্যুরে তরুণ সামরিক কর্মকর্তা আমাদের ওপর থেকে এক পলকের জন্যও চোখ সরাননি, আর এ জন্য পুরো সময়টা তিনি আমাদের দিকে মুখ করে উল্টো করে হেঁটেছেন। কারো সাথে ধাক্কা না খেয়ে বা সিঁড়িতে হোঁচোট খেয়ে না পড়ে এভাবে দক্ষতার সাথে উল্টো করে হাঁটা জীবনে প্রথম দেখলাম।
৯/১১-এ পেন্টাগনের যে স্থানে সন্ত্রাসবাদীরা যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সেটা আমাদের দেখানো হলো। ঐতিহ্যবাহী ভবনের ধসে যাওয়া অংশটি একই ধরনের উপাদান ব্যবহার করে আবারো আগের মতো করে মেরামত করা হয়েছে। সন্ত্রাসবাদীদের হামলায় নিহত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য একটি মেমোরিয়াল তৈরি করা হয়েছে। এ মেমোরিয়ালের পাশেই একটি কক্ষ রাখা হয়েছে, যেখানে সব ধর্মের মানুষ নিজ নিজ বিশ্বাস অনুযায়ী প্রার্থনা করতে পারে।
ওয়াশিংটন হলো মিউজিয়াম বা জাদুঘরের শহর। যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ জাতীয় জাদুঘরের ১৫টিই ওয়াশিংটনে অবস্থিত। মহাকাশসহ হরেক রকমের বিষয়ের ওপর এ সব জাদুঘর। কর্মসূচির ব্যস্ততার কারণে স্পেস মিউজিয়াম ছাড়া অন্যগুলোতে যেতে পারিনি। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পদচারণায় মিউজিয়ামটি ছিল জমজমাট।
আমেরিকায় এসে একটি বিষয় আমার খুব ভালো লাগল। আর তা হলো ট্রাফিক আইন মেনে চলার প্রতি নাগরিকদের সচেতনতা। আমাদের দেশের মতো লাল সিগনাল উপেক্ষা করে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা এখানে নেই। এমনকি পথচারী পারাপার হওয়ার জন্য সিগনাল পড়লেও তা কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। ট্রাফিক আইন মানার কারণে রাস্তায় প্রচুর গাড়ি থাকলেও জ্যাম খুব একটা চোখে পড়ে না। রাস্তায় চলাচলটাও অনেক নিরাপদ। আর গাড়ির হর্ন একটি বিরল ব্যাপার। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বেশিরভাগ আমেরিকান বেশ সচেতন। ফাস্টফুড রেস্টুরেন্টগুলো সেলফ সার্ভিস। খাবার পর উচ্ছিষ্ট নিজেকেই নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হয়। কাউন্টারে, তা রেস্টুরেন্ট বা বাসÑ যা-ই হোক না কেন, ধাক্কাধাক্কি নেই। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে যায়।
ওয়াশিংটের কর্মসূচি শেষ করে গাড়িতেই রওনা হলাম নিউইয়র্কে। ৬ ঘণ্টার রাস্তা। একমুখী চওড়া হাইওয়ে। মাঝখানে প্রায় ৩০ গজ ব্যবধানে বিপরীতমুখী রাস্তা। ফলে অপর দিক থেকে গাড়ি আসার টেনশনে থাকতে হয় না। মাঝে মধ্যে হাইওয়ে পেট্রল পুলিশের গাড়ি দেখা যায়। একটি ফুডকোর্টে মধ্যাহ্ন বিরতি হলো। খাবার দোকানগুলো সব এক সাথে। বুফে সিস্টেমে একটি প্লেটে খাবার নিয়ে কাউন্টারে দিলাম। কাউন্টারের মেয়েটা প্লেটটা ওজন করে বিল দিলো। মজার অভিজ্ঞতা।
দিগন্ত উঁচু ভবনের সারি দেখে বুঝলাম নিউইয়র্ক সামনে। স্ট্যাচু অব লিবার্টির শহর। ম্যানহাটনে একটি হোটেলের ২৩ তলায় ছিলাম আমি। কিন্তু আশপাশের ভবনগুলোর তুলনায় এটি তেমন উঁচু মনে হলো না। কয়েকটি ভবন যেন আকাশ ছুঁয়েছে। দেখলাম গ্রাউন্ড জিরো। এখানেই ছিল বিশ্বের এক সময়ের সবচেয়ে উঁচু ভবন টুইন টাওয়ার। ৯/১১ তে দু’টি যাত্রীবাহী বিমান ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদীরা এ ভবনের দু’টি টাওয়ারকেই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এখন সেখানে চলছে কনস্ট্রাকশন কাজ। হয়তো আবারো একই নকশার ভবন গড়ে তোলা হবে।
একটি নদী পার হয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টিতে যেতে-আসতে ২ ঘণ্টা সময় লাগে। সময় স্বল্পতার কারণে সেখানে যাওয়া হলো না। টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষের কাছেই একটি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে দূর থেকে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দেখলাম।
নিউইয়র্কে উপভোগ করলাম ‘ম্যান ইন দ্য ব্লু’ নামের একটি জনপ্রিয় থিয়েটার। এ থিয়েটারে পারফরমাররা দর্শকদের মাঝ থেকে কয়েকজনকে স্টেজে নিয়ে নানা রকম মজা করে। পুরো হলেই ওপর থেকে রিবন (লম্বা ফিতা) পড়ে থাকে। দর্শকরা একজন আরেকজনের দিকে তা ছুড়ে দেয়। আমেরিকানরা যে ইনফরমাল এবং মজাপ্রিয় মানুষ তা অনুধাবন করলাম।
থিয়েটার থেকে ফেরার পথে রাত প্রায় ১২টায় আমরা কয়েকজন নেমে গেলাম টাইমস স্কয়ারে। আলো ঝলময় এ জায়গাটি রাত বাড়ার সাথে সাথে জমজমাট হয়ে ওঠে। সেখানেই ম্যাকডোনাল্ডে বার্গার খেয়ে প্রায় ১ ঘণ্টা হেঁটে হোটেলে পৌঁছলাম। এরপর গভীর ঘুম।
নিউইয়র্কে নানা বর্ণ ও জাতির সংমিশ্রণ থাকায় এখানে অপরাধের প্রবণতা বেশি বলে শুনেছি। হলিউডের সিনেমা বা টিভি সিরিয়ালে এ সব অপরাধের নমুনা দেখা যায়। তবে আমরা তেমন কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম না। হয়তো নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অপরাধপ্রবণতা বেশি।
আমেরিকানদের সাথে কথা বলে তিনটি বিষয় জেনে আমি বিস্মিত হয়েছি। প্রথমত, রাজনীতি নিয়ে তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে তেমন আগ্রহ নেই। মার্কিন জাতীয় নির্বাচনে ভোট পরে মাত্র ৫০ শতাংশ। আর ভোট দিতে যাওয়া আমেরিকানদের বেশিরভাগই বয়ঃবৃদ্ধ। তাই মার্কিন সরকারগুলোর নীতি নির্ধারণে বয়ঃব্দ্ধৃ বা সিনিয়ন সিটিজেনদের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সিনিয়র সিটিজেনরা রাষ্ট্র থেকেও নানাবিধ সুবিধা পেয়ে থাকেন। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ আমেরিকানদের চিন্তাভাবনা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের বিশ্বে কি হচ্ছে তা নিয়ে তাদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের কোথাও যুদ্ধে জড়ালে প্রথম দিকে সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কিন্তু যুদ্ধে মার্কিনিদের হতাহত পরিমাণ বেড়ে যেতে শুরু করলেই সৈন্য দেশে ফিরিয়ে আনতে তারা সোচ্চার হয়।
তৃতীয়ত, ফ্রি সেক্সের দেশ হিসেবে আমেরিকার পরিচিতি থাকলেও তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। বিশেষ করে ওয়াশিংটনে আমি একটি রাস্তার ওপরই অনেকগুলো চার্চ দেখেছি। এসব চার্চের নকশার মধ্যেও একটি প্রাচীন ঐতিহ্যের চাপ রয়েছে।
নিউইয়র্ক থেকে টানা ৩ ঘণ্টা প্লেনে পৌঁছলাম টেক্সাসের রাজধানী অস্টিনে। বুঝলাম যুক্তরাষ্ট্রের আয়তন কত বড়। অস্টিন শহরটিকে স্বপ্নের মতো মনে হলো। কী সুন্দর করে সাজানো! পরিচ্ছন্ন, শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। ছিলাম হোটেল রেডিসনে, যার একটি শাখা ঢাকাতেও আছে। আমাদের হোটেলের পাশ দিয়েই একটি লেক বয়ে গেছে। লোকজন এ লেকের ধারে হেঁটে বেড়ায়, নৌকা নিয়ে আনন্দে মাতে। স্থানীয় এক মহিলা কথা প্রসঙ্গে অভিযোগের সুরে বলল, অস্টিন আগে আরো শান্ত ছিল। কম্পিউটার হার্ডওয়ার জায়েন্ট ডেল এখানে সদর দফতর করে গেড়ে বসার পর শহরের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। মহিলা যতই অভিযোগ করুক না কেন, আমি এবং দলের অন্যরা একবাক্যে স্বীকার করলাম যে, অস্টিন আমাদের দেখা সবচেয়ে সুন্দর শহর। টেক্সাসের ক্যাপিটল বিল্ডিং দেখে সত্যিই আমরা অভিভূত হলাম।
অস্টিনের শহরতলীতে বাস করা একটি মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের রাতের খাওয়ার দাওয়াত করেছিল। এ আমেরিকান পরিবারটির আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করল। দেখলাম টেক্সাসের অধিবাসীরা তাদের পরিচয় নিয়ে বেশ গর্ব করে। নিজেদের তারা টেক্সান হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
টেক্সাসের কর্মসূচি শেষ করে এলাম উইন্ডি সিটি শিকাগোতে। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার পরই আসে শিকাগোর নাম। লেক মিশিগানের তীরেই এ শহরের অবস্থান। এ লেকটি দেখে সমুদ্র বলে ভুল হতে পারে। এত বড়। আর লেকের হাওয়া এ শহরের ওপর দিয়ে বয়ে যায় বলেই এটা উইন্ডি সিটি। গ্রীষ্মের জন্য এ হাওয়া আরামদায়ক। কিন্তু শীতকালে কনকনে ঠাণ্ডা।
শিকাগো শহরটি আর্কিটেকচারাল ডিজাইনের জন্য বিখ্যাত। এটা উপভোগ করার জন্য নৌপথ ভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। আর্কিটেকচারাল ক্রুজ নামে পরিচিত এ নৌভ্রমণে গাইড শহরের বিভিন্ন সুউচ্চ ভবনের নির্মাণশৈলী ব্যাখ্যা করেন। একই সাথে পুরনো ভবনগুলো ঐতিহ্য তুলে ধরেন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানের শেষ দিনটিতে আমরা এ ক্রুজ উপভোগ করলাম।
ইমরান আলম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন