শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০১৪

ঙং পাহাড়ের কোলে - কেনিয়া

photo-12.JPGদ্য গ্রেট রিফ্ট ভ্যালে

নাইরোবি এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়িতে পরিচয় আফগানস্থানের মিরওয়াইজ দুররানির সাথে। খার্তুম থেকে আমরা একই ফ্লাইটে এসেছি, কিন্তু পূর্বপরিচয় ছিল না। গ্রীষ্মদেশীয় কেনিয়ার রাস্তার দু’পাশে নানা ফুলের আর রঙের সমাহার। জঙ্গল, পাহাড়, দরিদ্র মানুষজন, খোলা সবুজ মাঠে চড়তে থাকা ঘোড়া, গরু, রাস্তার পাশের ভাঙাচোরা ফার্নিচারের দোকান, বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা ফেরিওয়ালা, আর রাস্তার দু’পাশের ঘন সবুজ অতিক্রম হয়ে পৌঁছাই ট্রেনিং সেন্টারে। সবুজ পাহাড়ের ঢালে শত পাখির কাকলি, সকালের শিশিরে ভেজা পত্রপল্লবের মিষ্টি ভেষজ গন্ধ, সোনালি রোদের ছটা আমাদের ট্রেনিং সেন্টারে অভ্যর্থনা জানায়।
ট্রেনিং সেন্টার-এর লনে পরিচয় মার্কিন কর্নেল অ্যান্টন-এর সাথে। নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইল আমার নাম রাশিদা সুলতানা কিনা। আমি হ্যাঁ বলতেই কর্নেল বলে, “তুমি আমার সাথে একই সিন্ডিকেট-এ।” পাশে দাঁড়ানো আফগান মিরওয়াইজ দুররানির সাথে পরিচয় হলে বলে, “তুমিও সম্ভবতঃ আমাদের সিন্ডিকেটে।”
আমরা দু’জনেই প্রায় একসাথেই বলি, “কে কোন সিন্ডিকেটে সব মুখস্থ করে রেখেছ দেখছি। এই ট্রেনিং সেন্টারে কবে এসেছ তুমি?”
photo-13.JPG……..
কারেন ব্লিক্সেন মিউজিয়ামের পথে
……..
সে জানায়, গতকাল এসেছে। করার কিছু ছিল না, তাই রুম-এ ট্রেনিং ম্যাটেরিয়াল যা ছিল সেগুলো পড়েছে।
ট্রেনিং সেন্টারে দ্বিতীয় সন্ধ্যায় ছিল ‘নামচামো’ সোয়াহিলিতে নামাচামো অর্থ হচ্ছে ‘বারবিকিউ’ (আস্ত ছাগল পোড়ানো), এটি আফ্রিকানদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব। পাহাড়ের ঢালে সবুজ লনে পার্টি শুরু হবার খানিক পরই তুমুল বৃষ্টি নামে। হুড়মুড়িয়ে সবাই ট্রেনিং সেন্টারের বারান্দায় জড়ো হয় নামচামোর যাবতীয় সরঞ্জমাদি-সহ। বৃষ্টিতে, বাতাসে, ঘাসফড়িংয়ের মতো অসংখ্য পোকা পুরো বারান্দা দখল করে নিতে আসে। বারবিকিউ শেষ হবার আগেই আমরা ভিতরে ডাইনিং-এ চলে যাই।
ক্লাস শেষে একদিন কর্নেল অ্যান্টন আমাকে আর দুররানিকে বলে, “আমি তোমাদের সাথে ডিনার করতে চাইছি।” কর্নেল খানিক দূরে গেলে দুররানি বলে, “লোকটা নির্ঘাত আজ ইনটেলিজেন্স সংগ্রহ করবে। আমি আফগান আর তুমি বাংলাদেশি।”
ডিনার টেবিলে কর্নেল আফগান যুদ্ধ সম্পর্কে দুররানির মতামত জানতে চায়। মিরওয়াইজ বলে, আফগান জনগণ এখন যুদ্ধের অবসান চায়। প্রক্সি যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত তারা। একসময় ছিল আমেরিকা রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধ, ইন্ডিয়া-পাকিস্থানের, আর বর্তমানে ইরান ইউএস-এর।”
photo-16.JPGকারেন ব্লিক্সেন মিউজিয়ামের সামনে লেখক
আমি বলি, “বিন লাদেন তো তোমাদেরই তৈরি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন।” কর্নেল বলে, “আমাদের তৈরি, এভাবে বোলো না। রাশিয়া ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। রাশিয়াকে প্রতিহত করতে আমাদের যা করার দরকার ছিল তাই করেছি। তবে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান (নাম উচ্চারণের সাথে সাথে কর্নেলের চেহারা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে) সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করতে পেরেছে। রিগ্যান ওয়াজ আ রিয়েল হিরো।” তারপর বলে, “ইরান! ওহ! আহমেদিনিজাদ লোকটাকে কী মনে হয় তোমাদের? কী ভয়ঙ্কর তার কথাবার্তা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কী ভয়ঙ্কর কথা সে বলে। তার দেশের লোকজন তাকে ঘৃণা করে। মিডিয়াতে দেখেছ?” আমি বলি, “শুনেছি তার দেশের দরিদ্র মানুষজনের কাছে সে জনপ্রিয়।”
কর্নেল বলে, “তারা তো অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা সরল লোকজন। তবে আমাদেরও কিছু ভুল আছে, আফগানস্থানে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ শেষ হলে আমাদের হাত গুটিয়ে চলে আসা উচিত হয় নাই। ওখানে কোনো ক্যাম্প বা বেস থাকা উচিত ছিল। তাহলে আফগানস্থানে আজকের সমস্যা তৈরি হত না।”
আমি বলি, “বাহ! তোমাদের বেস থাকলেই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?”
কর্নেল বলে, “আরও একটা ভুল আমাদের হয়েছে। প্রথমবার ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ঠিক হয় নাই। তখনই, ঐ সময়ই, বিন লাদেন আমেরিকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়।”
দুররানি বলে, “আমেরিকার এই সামান্য “ভুল”-গুলোর জন্য পৃথিবীর শত শত নারী শিশু ও বেসামরিক লোকের প্রাণ দিতে হয়।”
কথা হচ্ছিল পশতুনদের নিয়ে। দুররানি বলল, “আমাদের অতিথি-বৎসলতার গল্প হয়তো তোমরা জানো। আহত এক মার্কিন সৈন্য আশ্রয় চেয়েছিল এক পশতুন পরিবারের কাছে। তারা তাকে আশ্রয় দেয়। সেবা যত্নে সুস্থ করে তোলে। তালেবানদের কাছে তাকে ধরিয়ে না দিয়ে মার্কিন ক্যাম্পে সংবাদ পাঠিয়ে নিরাপদে তাকে সেখানে পৌঁছে দেয়। মার্কিন সেই সেনা অফিসার দেশে ফিরে গিয়ে এ বিষয়ে বই লিখেছে।” সে হাসতে হাসতে আরো বলে, “ওসামা বিন লাদেনও হয়তো কোনো পশতুন পরিবারের কাছেই আশ্রয় নিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে। লাদেন হোক আর মার্কিন সৈন্য হোক পশতুনরা কখনোই অতিথিকে শক্রুর হাতে তুলে দিবে না। অতিথি বলে কথা।” আমরা সশব্দে হেসে উঠি এ-কথায়।
আমাদের টেবিলে যখনই কোনো আফ্রিকান কোর্সমেট এসে বসে অথবা টেবিল অতিক্রম করে যায়, তারা মার্কিন কর্নেলকে ‘হ্যালো স্যার, হাউ আর ইউ স্যার’ বলতে বলতে মুখে প্রায় ফেনা তুলে ফেলে। আবার সাদা-চামড়ার এই মার্কিন কর্মকর্তার সাথে ছবি তোলার জন্য নানা সময় লাইন দেয় আফ্রিকানরা। কর্নেলকে বলি, “তুমি তাদের ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকেও স্যার বলছ না, অথচ আফ্রিকান অফিসাররা তোমাকে সারাক্ষণ স্যার স্যার করছে, তোমার সাথে ছবি তোলার জন্য লাইন দিচ্ছে। আমার দেশেও এর ব্যতিক্রম খুব বেশি নাই। কলোনিয়াল হ্যাঙওভার। কন্ডিশনড।”
photo-14.JPG……..
দ্য গ্রেট রিফ্ট ভ্যালে-এ কোকাকোলার পক্ষ থেকে স্বাগত-বিলবোর্ড
……..
অ্যান্টন হাসে। বলে, “লক্ষ করেছ, এরা কলোনিয়াল যুগের ব্রিটিশ ইউনিফর্ম পরে আছে- খাকি টিউনিক, কোমরে বেল্ট, এমনকি পুলিশ সুপারদের বগোলে লাঠি। এখনও কলোনিয়াল যুগের ব্রিটিশদের সবকিছু অক্ষুন্ন রেখেছে। একটুও বদলায়নি। আসলেই কলোনিয়াল হ্যাঙওভার।” কর্নেল হাসে। হয়তো মনে মনে পূর্বপুরুষ ব্রিটিশদের জন্য গর্বিত বোধ করে। মনে মনে ভাবি, হায়, আমার দেশেও তো পুলিশ মিলিটারি ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া খাকি পোশাকিতা এখনও ধরে রেখেছে; আমার দেশে গেলেও লোকটা এরকমই হাসত।
তবে এর ব্যতিক্রমও দেখেছি। কেনিয়ার অ্যাঞ্জেলা, ফ্লোরেন্স, নাইজেরিয়ার ইন্নিহ্, জিবুতির গেল্লা, আরও দু’একজনকে দেখেছি নিজস্বতা বজায় রেখেই ক্লাসে, সিন্ডিকেট মিটিং-এ, আড্ডায় অংশ নিয়েছে। কখনোই তাদের দেখি নি সাদাদের বাড়তি তোয়াজ করতে।
এক সন্ধ্যায় লাইবেরিয়ার সংঘাতের ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখায়। সেখানে জানা যায় আমেরিকা দেশটাকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে। আমেরিকানরা চলে যাবার পর থেকেই সংঘাতের সূত্রপাত হয় সে দেশে। দলাদলি ও বীভৎস হত্যাকা- চলতে থাকে। তাদের সংঘাতের পিছনেও আমেরিকান লাইবেরিয়ানরা দায়ী।
প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়, আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি ফায়ারস্টোনের উপস্থিতি। সারি সারি মৃতদেহ দেখতে দেখতে জিবুতির লে: কর্নেল গেলণ্ঢা মার্কিন কর্নেলকে জিজ্ঞাসা করে, “ লাইবেরিয়ার এত সমস্যায় আমেরিকা বর্তমানে কী ভূমিকা পালন করছে?”
কর্নেল বলেন, “কী বিপদ! আমেরিকা কোথাও হস্তক্ষেপ করলেও সমস্যা, না করলেও সমস্যা!”
চা বিরতিতে আমি কর্নেলকে বলি, “এই তথ্যচিত্রে দেখলাম রাশিয়ার বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরির জন্য তোমরা লাইবেরিয়াকে ব্যবহার করেছ।”
কর্নেল বলে, “দেখো, সাদা আমেরিকানরা লাইবেরিয়ার সমস্যার জন্য দায়ী নয়। আমাদের “প্রাক্তন দাসেরা” এজন্য দায়ী বলতে পারো।
মার্কিন দক্ষিণের রাজ্য সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে আগত অ্যান্টনের কথাগুলি ঘুরেফিরে আমার মাথায় বার বার আসে। অন্য নানা কথাও। দার্ফুরে আমার সহকর্মীদের অনেকেই আফ্রিকান, ভারতীয় বা অন্যদেশীয়; যাদের আমেরিকা বা কানাডার দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে তাদের যদি কেউ সোমালিয়ান, পাকিস্তানি বা ইন্ডিয়ান বলে, তাদের রীতিমতো নাখোশ হতে দেখেছি।
তিনচারদিন টানা বৃষ্টি। বিশাল সব গাছের গুঁড়িতে, কাণ্ডে, শাখা-প্রশাখায় ঝুলন্ত নানা অর্কিড, বুনোলতা, ফুল। ক্লাসে যাবার ইটের সিঁড়িতে কোথাও শ্যাওলার আস্তর। পাশে ঘাস, থানকুনি পাতা, হলুদ বেগুনি ফুল জড়াজড়ি করে থাকে। দিনের বেলাও ঝিঁঝির শব্দে চারপাশ মুখর।
আরেক সন্ধ্যায় ছিল আফ্রিকান নাইট। আফ্রিকান নৃত্যগীতের সাথে আফ্রিকান খাবার পরিবেশন করা হয়, যার মধ্যে ছিল সিদ্ধ মিষ্টি-আলু, সবুজ শাক-সিদ্ধ, কচু-সিদ্ধ, গরুর মাংসের স্টু, কাঁচকলা-সিদ্ধ।
এক রাতে ডাইনিং টেবিলে জাপান প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি বললাম, “জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা ফেলে মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ তোমরা করেছ তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ কখনও করে নাই।”
কর্নেল বলেন, “জাপানিরা বন্দিদের প্রতি কত সীমাহীন নিষ্ঠুর আচরণ করত তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। জাপানিদের বুশিদো স্পিরিট-এর কথা জানো তো? জাপানিরা এক ভিন্ন ধরনের জাতি। আমেরিকানরা মনে করে জাপানে আণবিক বোমা না ফেললে এই যুদ্ধে হয়ত আরো অনেকবেশি বেসামরিক মানুষ মারা যেত। যুদ্ধ শেষ হতেও অনেক সময় লাগত।”
আমি বলি, “দারুণ ব্যাখ্যা! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিদের জন্য সংবিধান লিখে তোমরা আমেরিকানরা তাদের উপহার দিয়েছ। তাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদে লিখে দিয়েছ জাপান কোনোদিন সামরিক শক্তির অধিকারী হতে পারবে না। শুধু তাদের সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স থাকবে।”
কর্নেল হাসে। তার মুখ আবারও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। “জেনারেল ম্যাকআর্থার। মার্কিন ইতিহাসে মাত্র পাঁচজন ফাইভস্টার জেনারেলের মধ্যে একজন। মার্কিন সেনাবাহিনীর অসামান্য মেধাবী কর্মকর্তা। তিনি জাপানিদের বিলক্ষণ চিনেছেন। এজন্যই জাপান যেন কখনও সামরিক শক্তির অধিকারী হতে না পারে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।” কর্নেল বলে যায়, “আমার বাবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ফিলিপিনে যুদ্ধ করেছেন জাপানিদের বিরুদ্ধে। তিনি সতের বছর বয়সে তাঁর বাবাকে হারিয়েছিলেন। ত্রিশ-এর মন্দায় আমাদের দাদা অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন। বাবা হয়তো বিশ্বযুদ্ধে মানুষ মেরেছেন, কিন্তু কোনোদিন যুদ্ধের এসব গল্প বা তিনি কখনও কাউকে হত্যা করেছেন কিনা এসব কাউকে বলেন নাই। অল্প বয়সের তুলনায় শেষ বয়সে বাবা অনেক উদার এবং দয়ালু হয়ে উঠেছিলেন। অথচ মৃত্যুর আগ-পর্যন্ত বাবাকে কোনোদিন বলতে শুনি নাই হিরোশিমা নাগাসাকিতে বোমা ফেলা আমেরিকার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। অন্যদিকে দেখো নাৎসিরা কীভাবে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে মানুষ মেরেছে। ব্যাপার ভাবতে অবাক লাগে দে ওয়্যার ইয়োরোপিয়ানস! দে আর হোয়াইট অ্যান্ড দে আর ক্রিশ্চিয়ানস অলসো! কীভাবে তারা এত নিষ্ঠুর হল!”
আমি বলি, “তোমরা হোয়াইট এবং ক্রিশ্চিয়ানরা আনবিক বোমা ফেলেছ, ভিয়েতনাম, আফগানিস্থান, ইরাকে এত মানুষ হত্যা করেছ, তোমরা নিষ্ঠুর না?”
মিরওয়াইজ বলে, “আমার তো মনে হয় তোমরা সাদা এবং খ্রিস্টান ইউরোপিয়ান জামার্নদের উপর আণবিক বোমা না ফেলে জাপানিদের ওপর ফেলেছ তারা অসাদা এবং অখ্রিস্টান বলেই।”
কর্নেল বলে, “তোমাদের দু’জনের এত আমেরিকা বিদ্বেষ!” মিরওয়াইজ হাসতে হাসতে বলে, “এশিয়ানরা খুব খারাপ। জাপানিদের তো চিনেছ। ভিয়েতনামিদের তোমরাই সবচেয়ে ভালো চেনো। আফগানিস্তান একটা দেশ যে কখনোই কারো উপনিবেশ ছিল না।”
প্রতিদিনই ক্লাসে পাওয়ার-পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন থেকে হারিয়ে যেতাম কাচের দরজার বাইরে দুর্বিনীত সবুজে। নীল, বেগুনি, হলুদ, লেজঝোলা নানা রঙের পাখির কাকলিতে-নৃত্যে, আর ক্লাসের বিরতিতে দেখতাম দূরে ঙং পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের, কুয়াশার খেলা।
সঙ্গীত নিয়ে এক আলাপচারিতায় অ্যান্টন জানায় ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত এবং পিয়ানোর ভীষণ ভক্ত সে। জনপ্রিয় ধারার র‌্যাপ সঙ্গীতের প্রসঙ্গে বলে, “আমেরিকার বিশেষকিছু গোত্রের লোকজন এইসমস্ত শস্তা জনপ্রিয় সংস্কৃতি তৈরি করেছে। কি অশ্লীল এসবের লিরিকস। কানে তোলা যায় না।”
ট্রেনিং সেন্টারে কর্নেলকে একদিনও ড্রিংক করতে দেখি নাই। তাদের নাকি মিশনে গেলে পান করা নিষেধ আছে। আমেরিকাতে মাঝেমধ্যে ড্রিংক করে। জেনেছি সময়-সুযোগ পেলেই নিয়মিত বাইবেল পাঠ করে।
photo-20.JPG……..
নাইভাসা লেক-এ মিরওয়েজ দুররানি ও অ্যান্জেলার সাথে লেখক
……..
কেনিয়াতে দেখেছি উপনিবেশিকদের সন্তানেরা দামি গাড়ি, দামি বাড়ি, তাদের নিজেদের ক্লাব, রেস্টোরান্ট সব মিলিয়ে এখনও প্রভুর মতো অথবা প্রভুদের সন্তানদের মতোই আছে। শুনেছি কেনিয়ার রাজনীতিতে ও অর্থনীতিতে প্রাক্তন কলোনাইজার ব্রিটিশদের ব্যাপক প্রভাব আছে। তবে কেনিয়ানদের আতিথেয়তা, সারল্য ও আন্তরিকতায় মুগ্ধও হয়েছি।

‘ I had a farm in Africa, at the foot of the Ngong Hills.’
উইকএন্ডে একদিন গ্রেট রিফট উপত্যকা এবং নাইভাসা হ্রদে বেড়াতে যাই। জানা যায়, গ্রেট রিফট ভ্যালি ধরে সুবিশাল পর্বতশ্রেণীর মাঝ দিয়ে যে প্রশস্ত এবং দীর্ঘ সড়কটি গেছে, সেটি তৈরি করে ব্রিটিশদের হাতে সেসময়কার ইতালীয় যুদ্ধবন্দিরা। যুদ্ধবন্দি ইতালিয়দের ব্রিটিশরা নিয়ে এসেছিল পাহাড় জঙ্গল কেটে সড়ক নির্মাণের জন্য। অনেকেই এই নির্মাণের সময় মারা যায়। ঝকঝকে এই সড়ক অতিক্রমণের সময় ঐ যুদ্ধবন্দিদের দীর্ঘশ্বাস আর আহাজারি অনুভব করি। পার হই লংগনট, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। আমরা যাই নাইভাসা লেক-এ, আর আমাদের নৌকার পাশেই মাথা উঁচু করে থাকে কয়েকটা জলহস্তী। ভয় পেয়ে আফগান মিরওয়াইজ মাঝিকে বলে এখান থেকে দ্রুত নৌকা ফেরাতে। মিরওয়াইজের ভয় দেখে আমি আর অ্যাঞ্জেলা দু’জনেই একসাথে হেসে উঠি।
photo-8.JPGনাইভাসা লেক-এ হিপোপটেমাস
নাইভাসা লেক-এ বক, সারস-সহ শত পাখির ওড়াউড়ি। পিছনে লংগনট, ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। নাইভাসা লেক থেকে যাই সেরেংগেতি রিজার্ভ ফরেস্ট-এ। ‘আউট অব আফ্রিকা’ ছায়াছবির বিভিন্ন সাফারি দৃশ্যের চলচিত্রায়ণ হয়েছিল এখানে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য এখানে মাংশাসী কোনো প্রাণী নাই। চলচ্চিত্রের শুটিং-এর জন্য আমেরিকা থেকে পোষা সিংহ এনে এখানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। মেরিল স্ট্রিপ, রবাট রেডফোর্ড চোখের সামনে ফিরে আসে নানা অভিব্যক্তি আর সংলাপ নিয়ে।
লংগনট ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির পটভূমিতে উঁচু ঘাসে হরিণ, জেব্রা ছাড়াও হাজারো পশুপাখি চড়ে বেড়াচ্ছে, ছুটছে। গায়ের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে জেব্রা অথবা ইলান্ডের দল। একশ’ ভাগ আদিম। আধ্যাত্মিক আর অপার্থিব। পাখির কাকলি, পশুদের শব্দ এমন মধুর হতে পারে কোনোদিন ভাবি নাই। মনে হচ্ছিল আদম হাওয়াকে ঠিক এমনই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন আল্লাহ্।
এক ডিনারের আড্ডায় অ্যান্টন জানাল কারেন বি−ক্সেন মিউজিয়াম আমাদের ট্রেনিং সেন্টারের খুব কাছেই। মনে পড়ে কারেন বি−ক্সেন-এর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘আউট অব আফ্রিকা’র চলচ্চিত্র রূপ দেখে আফ্রিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের প্রেমে পড়েছিলাম। কারেনের প্রেমিক ডেনিস ফিঙ্ক হাটনের কবরও ঙং হিলে কোথাও। উইকএন্ডে গেলাম কারেন বি−ক্সেন জাদুঘরে। কারেন কান্ট্রি ক্লাব, কফি এস্টেট পার হয়ে যখন মিউজিয়ামে পৌঁছাই, বাড়িটিতে শেষ বিকালের আলো। সামনে সবুজ ঘাসের লন, দূরে নীলাকাশে মাথা তুলে থাকা ঙং পাহাড়। বাড়িটিতে পা দিতেই কারেন বি−ক্সেনের সময়ে চলে যাই, ভাবি, কারেন প্রতিদিন তার বাড়ি থেকে এই পাহাড়টি দেখত। চলচ্চিত্রের নানা দৃশ্য, ‘আউট অব আফ্রিকা’ বইয়ের নানা শব্দাবলি আমার মাথায় অনুরণন তোলে। বাড়ি থেকে যে ঙং পাহাড় দেখা যায় সেখানে কারেনের প্রেমিক ডেনিস তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী শায়িত আছেন। বাড়ি থেকে প্রেমিকের কবর চিহ্নিত করার জন্য কারেন ঙং পাহাড়ে হাটনের কবর কাপড় দিয়ে ঘিরে দিয়েছিল। ইতিহাসের বাড়িতে ঢুকি। বাড়ির ভিতরে সব পার্টিশান দেয়াল মেহগনি কাঠের। ঢুকেই বাঁদিকে প্রথম রুমে তার বড় বড় ছবি। তার বন্দুক রাখার স্থান। লোহার সিন্দুক। মাথায় হ্যাট পরা সুন্দরী ব্যারনেস। ভাইয়ের সাথে ছবি। ভাই তার কফি খামারে ম্যানেজারের কাজ করত। স্বামীর সাথে দাঁড়ানো ছবি। পায়ের কাছে শিকার করা সিংহ, গর্বিত ব্যারন আর ব্যারনেস। ডাইনিং রুমে তার ব্যবহৃত চেস্ট অব ড্রয়ার, দেওয়ালে তার আঁকা চিত্রকর্ম। আফ্রিকান নারীর, কিশোরের পোট্রেট। তিনি চিত্রকরও ছিলেন। ডাইনিং রুমের বাঁপাশের কোনায় কোনো চিত্রকরের আঁকা তার বৃদ্ধ বয়সের একটি পোর্ট্রেট। মাথায় হ্যাট পরিহিত, অতিশীর্ণকায়, ফ্যাকাসে, ধুমপায়ী কারেন।
মিউজিয়ামে কেনিয়ান গাইড বলে, “তিনি কেনিয়ানদের খুবই ভালবাসতেন। কালোদের ভালবাসতেন বলেই তিনি দুইবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হবার পরও পুরস্কার দেওয়া হয়নি।” উপস্থিত কেনিয়ানরা গভীর মনোযোগে এ কথা শোনে।
লিভিংরুমে প্রচুর বই। ইউরোপ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর দুটো ভিন্ন বেডরুম। এটাই নাকি তৎকালীন অভিজাত ইউরোপীয়ানদের দস্তুর ছিল।
কারেন তার স্বামীর সাথে ডিভোর্স হয়ে যাবার পর প্রেমিক ডেনিস ফিঙ্ক হাটনকে নিয়ে এ বাড়ীতেই থাকতেন।
কারেন বি−ক্সেন, আইজাক ডেনিসন ছদ্মনামে সাহিত্য চর্চা করতেন। নারী লেখকদের সাহিত্যের মান নিয়ে সেসময় বুদ্ধিজীবীরা খুবই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। যে কারণে পুরুষের ছদ্মনামেই কারেনের সাহিত্যযাত্রা শুরু।
কারেন ব্রিটিশ পূর্ব-আফ্রিকা বা বর্তমান কেনিয়ায় আসেন ১৯১৩ সালের শেষ দিকে। তিনি আসেন তার আত্মীয় সুইডিশ ব্যারন ব্রোর ভন বি−ক্সেনকে বিয়ে করতে। তরুণ ব্যারন এবং ব্যরনেস নাইরোবি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঙং পাহাড়ের কাছে খামারের জন্য জমি কিনে কফি উৎপাদন শুরু করেন। তার কফি খামারের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিল ইউরোপীয়ানরা। প্রায় ৭০০ স্থানীয় মজুর ছিল কারেনের খামারে। তারা ছিল স্থানীয় কিকুয়ো গোত্রের লোকজন। তারা খামার মালিকদের ১৮০ দিনের জন্য শ্রম দিতে চুক্তিবদ্ধ হত। বিনিময়ে সামান্য মজুরি আর খামারের অচাষাবাদযোগ্য জমিতে বসবাসের অনুমতি পেত। অথচ ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপনের আগে যুগ যুগ ধরে কিকুয়োরাই ছিল এই সমস্ত জমির মালিক।
কারেনের স্বামী তার প্রতি অবিশ্বস্ত ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কারেনের উপস্থিতিতেই তার অন্য প্রেমিকা নিয়ে হাজির হতেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে কারেন সিফিলিসে আক্রান্ত হন। ব্যাধিমুক্তির জন্য প্রতিদিন তাকে কয়েক ফোঁটা আর্সেনিক খেতে হত।
কারেন বি−ক্সেন মিউজিয়ামের গাইড জানায় সে তার স্বামীর কাছে থেকে এ রোগ পেয়েছিল। আবার এও শোনা যায় যে তার বাবার সিফিলিস ছিল। উত্তরাধিকার সূত্রে সে তা পায়। শেষের দিকে ফিঙ্ক হাটনের সাথে কারেনের সম্পর্ক বেশ অস্থিরতায়ে কাটে। কিছুকাল পরেই ফিঙ্ক হাটন তাঁর নিজস্ব বিমান জিপসি মথ-এ দুর্ঘটনায় মারা যান। ‘আউট অব আফ্রিকা’ ছবিতে আমি ডেনিস ফিঙ্ক হাটনকে ততটা চিনে উঠি নাই, যতটা চিনেছি কারেন বি−ক্সেনের ‘আউট অব আফ্রিকা’ বইটি পড়ে। প্রেমিক ডেনিস ফিঙ্ক হাটনকে কারেন ভীষণ ভালবাসতেন। প্রত্যাশা ছিল হাটন তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু ফিঙ্ক হাটন চাননি স্থায়ী কোনো বন্ধনে জড়াতে। ব্যবসায়ে ঋণে আকণ্ঠ ডুবে যাওয়ার পর হয়তো প্রত্যাশা ছিল হাটন তাকে বিয়ে করলে তাঁর স্ত্রী হিসাবে তার প্রিয় আফ্রিকায় থেকে যাওয়া হবে। স্বামীর সাথে ডিভোর্সের পর এই বাড়িতেই প্রেমিকের সাথে থাকতেন। মেহগনি কাঠের দেয়ালে, ঘরের বাতাসে লেখকের একাকিত্ব, প্রণয়, প্রেমিকের মৃত্যু… ব্যথায় প্রতিদিন আর্সেনিক নিতে থাকা লেখকের অশরীরী আলোছায়া তৈরি হয় বাড়িটিতে আর আমার মনের ভেতর।
photo-15.JPGনাইভাসা লেক-এ বকের বিচরণ
স্বামীর সাথে দাম্পত্য সম্পর্ক অবসানের পর কারেন একাই কফি খামার পরিচালনা করে। খুবই স্বনির্ভর আর দক্ষ কর্মী ছিল সে। তার কাজ, খামার, খামারের কর্মী, ঙং পাহাড় এলাকায় অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, এসবই ভালবাসা। কিন্তু মাটি এবং আবহাওয়া কফি চাষের অনুপযুক্ত হওয়ায় তার ব্যবসায় লোকসান হতে থাকে, দিনে দিনে আকন্ঠ ঋণে ডুবে যেতে থাকে কারেন। ঋণ মেটাতে এমনকি তার অধিকাংশ আসবাবপত্র বিক্রি করে দিতে হয়। ১৯৩১ সালে খামারটি বিক্রি করে দেয় সে।
‘আউট অব আফ্রিকা’ বইয়ের শেষে কফি খামার, তার বাড়ি, আসবাবপত্র, সব বিক্রি করে ট্রেনে চেপে সমুদ্র বন্দরের দিকে রওয়ানা দেয় কারেন, আফ্রিকা ছেড়ে চলে যাবার জন্য। তার অনেক স্মৃতির অতিপরিচিত ঙং পাহাড় চোখের সামনে অপসৃত হয়ে যায় চিরকালের জন্য।
আফ্রিকার জন্য কারেনের বেদনা শুধু যে ব্যবসায় ক্ষতি আর প্রেম হারানোর বেদনা তা নয়, বরং সেটলারদের স্বর্গরাজ্য কেনিয়া হারানোর ব্যথা।
কারেন উপনিবেশ যুগে সাদা ও কালোদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখেছে, আর দশজন ঔপনিবেশিকেরই মতো। “the highlands were in very truth the Happy Hunting Grounds…. while the pioneers lived in guiless harmony with the children of the land.”
কারেনের আফ্রিকা বর্ণনায়, অনুদ্ধারযোগ্যভাবে হারিয়ে যাওয়া এক জগতের জন্য শোচনা দেখা যায়, সেই জগতের রঙ-রস, এক রাজসিক বিবিক্ততা আর প্রকৃতির সহবাসী জীবনের শুশ্রƒষা তার রচনাকে অভিষিক্ত করে।
বিংশশতকের প্রথম দুই দশকে অধিকাংশ ইউরোপীয় সেটলারদের কাছে কেনিয়া ছিল ‘Timeless Paradise’। প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট, চার্লস, প্রিন্স অব ওয়েলস-সহ আমেরিকা ইউরোপের বহু ধনকুবের কেনিয়ায় সাফারিতে আসেন।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা কেনিয়ায় ব্রিটিশ আইন ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেও তারা নিজেদের অত্যাচারী, নিষ্ঠুর ও ঔপনিবেশিক মনে করত না। তারা নিজেদের দাবি করত “benign stewards of the land and its people.”
বি−ক্সেন যদিও ক্ষমতাধর ভূস্বামী ছিল, তার কর্মচারী মজুর এবং স্থানীয় আফ্রিকানদের সাথে তার ভালবাসা ও শ্রদ্ধার সম্পর্কের জন্য সে সুখ্যাতও ছিল। সে সময় তার দেখা কিকুই, মাসাই, সোমািল মুসলমান এবং ভারতীয় ব্যবসায়ীদের প্রতি সে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করত।
তার সমসাময়িক অন্যান্য ইউরোপিয়ানরা যেভাবে আফ্রিকানদের জংলি, নিষ্ঠুর, বর্বর, বোকা, এ-সমস্ত লেবেল এঁটে দিত, কারেন তাদের ব্যতিক্রম ছিল। আফ্রিকান সব গোত্রেই বয়স্কদের সম্মানের চোখে দেখা হয়। কন্যা পক্ষকে গরু, ছাগল ইত্যাদি নানা যৌতুক দিয়ে আফ্রিকান ছেলেদের বিয়ে করতে হয়। অন্যান্য ইউরোপিয়ানরা একে কুৎসিত প্রথা মনে করলেও কারেন বি−ক্সেন এ-সমস্ত প্রথার মধ্যে যুক্তি, সম্মান, সুসংস্কৃতির চিহ্নই দেখত।
প্রেমিক ফিঙ্ক হাটনকে সে এঁকেছে একধরনের ‘ফিলসফার কিং’-রূপে। অসামান্য পা-ণ্ডিত্য এবং একই সাথে চরিত্রের সহজাত মহিমা, প্রকৃতির সঙ্গে আত্মার যোগ-থাকা এমন একজন যে সবজায়গাতেই মানানসই, আবার ঠিক কোনো জায়গাতেই নয়।
“When he came back to the farm, it gave out what was in it; it spoke - as the coffee plantations speak, when with the first showers of the rainy season they flower, dripping wet, a cloud of chalk …When I heard his car coming up the drive. I heard, at the same time, things of the farm all telling what they really were.”
এই বাড়িটি ছাড়া ডেনিশ ফিঙ্ক হাটনের অন্য কোন বাড়ি ছিল না। বিভিন্ন সাফারিতে যাওয়ার মাঝের সময়টুকু এ বাড়িতেই তিনি সময় কাটাতেন। তার বই এবং গ্রামোফোন এ বাড়িতেই থাকত।
ডেনিস ফিঙ্ক হ্যাটন অভিজাত ব্রিটিশ পরিবারে জন্মেছেন এবং অক্সফোর্ড ও ইটনে পড়ালেখা করেছেন। হাটন ১৯১১ সালে ২৪ বছর বয়সে আফ্রিকায় আসেন ব্যবসায়ী হিসাবে। তাঁর “তুখোড় শিকারী” পরিচয় অন্য সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। আফ্রিকানরা তাঁকে ভালবাসত। কারেনের সাথে দেখা হয় ১৯১৮ সালে এক ডিনারে। তিনিই ছিলেন কারেনের জীবনের সেরা প্রেম। “To love the ground he walks upon, to be happy beyond words when he’s here and to suffer worse than death when he leaves.”
কিন্তু হাটন ছিলেন কারেনের মতোই আরেকজন, যে কখনও সামাজিক নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। কারেনের এই প্রেমে আনন্দ যেমন ছিল, বেদনাও কম ছিল না। কারেনকে নিয়ে ফিঙ্ক হাটন তাঁর জিপসি মথ পে−নটিতে ঘুরে বেড়াতেন ঙং পাহাড়ের মেঘরাজ্যে। কারেনের বর্ণনায় এটি ছিল তার আফ্রিকা জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় ঘটনা। কিন্তু ফিঙ্ক হাটন কারেনের সাথে স্থায়ী কোনো সর্ম্পক গড়তে আগ্রহী হন নাই। কারেন একবার তাঁর সন্তানধারণ করে এবং তার গর্ভপাত ঘটে। বিয়ে করে স্থায়ী সম্পর্কে কারেন যেতে চাইলেও হাটন তা চান নি।
photo-18.JPG……..
কেনিয়ার কারেন এলাকায় ট্রেনিং-এ লেখক
……..
ডেনিস ফিঙ্ক হাটন ছিলেন জাদু-ব্যক্তিত্ব। তাঁর পথে পথে ভালবাসা ছড়ানো ছিল। রসবোধের কারণে সারাজীবনই সব মানুষের প্রিয়পাত্র ছিলেন। শিল্প, কবিতা, সঙ্গীত সবকিছুতেই তাঁর তুখোড় পারদর্শিতা ছিল। ভালবাসার পাত্র ছিলেন আফ্রিকানদেরও। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পূর্বে পর্যন্ত কারেনের সাথেই তিনি থাকতেন। বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলে তাঁর মৃতদেহ কারেনের কাছেই পৌঁছে দেওয়া হয়। মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঙং পাহাড়েই সমাধিস্থ করা হয়। ডেনিস ফিঙ্ক হাটন মৃত্যুর পরও আফ্রিকার আদিম ও স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মাঝে থাকতে চেয়েছিলেন। তাঁর সমাধিতে তাঁর পরিবারের সদস্যরা কোলরিজের কবিতা উৎকীর্ণ করে দেয় :
‘He prayeth well, who loveth well
Both man and bird and beast.’
কারেন বি−ক্সেনের বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই তার ব্যর্থ দাম্পত্য, প্রণয়, ফিঙ্ক হাটনের মৃত্যু, ঋণে আকণ্ঠ নিমজ্জিত কারেনের বাড়ির সব আসবাব বিক্রি করে দেওয়া, বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া, ধূমপায়ী, নিঃসঙ্গ, অসুস্থ, আর্সেনিক খেতে থাকা লেখক, তার বাড়ির জানালায় দৃশ্যমান প্রেমের তীর্থ ঙং পাহাড়, তার একাকিত্ব, বেদনা, সবই আমার মধ্যে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়। বাকি যে কয়দিন কেনিয়াতে ছিলাম কারেনের ঘোরেই আচ্ছন্ন ছিলাম আমি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন