সুবর্ণা. প্রিয় শ্রোতা, সবাই ভালো আছেন তো? আজকের 'চলুন বেড়িয়ে আসি'
আসরে আপনাদের স্বাগত জানাই, আমরা আপনাদের বন্ধু সুবর্ণা আর আলিম। নতুন বছর
এসেছে, চলে গেছে আরো একটি বছর আমাদের জীবন থেকে। গেল বছরে আমরা আপনাদের
নিয়ে চীন ও বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছি। একজন পর্যটক হিসেবে বিশ্বের
বিভিন্ন অঞ্চলে বেড়াতে যাওয়া একটি দারুণ মজার ব্যাপার।
আলিম. নতুন বছরে কোথায় কোথায় বেড়ানো যায়, তা নিয়ে পর্যটকরা নিশ্চয়ই মাথা ঘামাচ্ছেন। গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকেও ভ্রমণ চীনাদের কাছে তেমন একটা জনপ্রিয় ছিল না। অনেক চীনা এ ব্যাপারে এক্কেবারেই সচেতন ছিলেন না। আশির দশকে এসে অনেক চীনার মনে ভ্রমণ বিষয়টি স্থান পায়। তখন অবশ্য বেশিরভাগ চীনাই ভ্রমণ বলতে বুঝতেন কাজের খাতিরে বাসা থেকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে থাকাকে। নব্বইয়ের দশকে চীনাদের জন্য তিব্বতের লাসা শহরে বেড়াতে যাওয়া একটি দারুণ মজার ব্যাপার ছিল। কিন্তু একুশ শতকে এসে প্রায় সকল চীনার জীবনে ভ্রমণ একটি প্রয়োজনীয় অংশে পরিণত হয়েছে। 'রাস্তায় আছি' এবং 'লাগেজ নিয়ে যে কোনো স্থানে বেড়াতে যাওয়া' শব্দগুচ্ছ এখন চীনাদের কাছে খুবই পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত।
সে যাক, গত কয়েক দশক ধরে ভ্রমণ সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারা অনেক উন্নত হয়েছে। মানুষ এখন স্রেফ বিনোদনের জন্য ভ্রমণ করে না, জীবনকে সমৃদ্ধ করতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান ও জাতি সম্পর্কে জানার পরিধিকে বিস্তৃত করতেও ভ্রমণ করে। প্রিয় শ্রোতা, বিশ্বে অনেক সুন্দর দর্শনীয় স্থান আছে, আপনারা সেটা জানেন। গত বছরের মতো এ বছরেও আমরা আপনাদের নিয়ে যাব সুন্দর সুন্দর সব পর্যটন স্থানে; আর ঘুরে বেড়াবো মনের আনন্দে। আজ চলুন বেড়িয়ে আসি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দ্বীপ মালদ্বীপে।
সুবর্ণা. মালদ্বীপ আমার কাছে একটি দারুণ সুন্দর ও মজার পর্যটন স্থান। এক সময় আমার একটি পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনাটি হচ্ছে: দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ দেশেই হবে আমার হানিমুন। কিন্তু মানুষের সব পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় না। সময় ও পরিস্থিতির কারণে, মালদ্বীপে আমার হানিমুন হয়নি। এখন ভাবছি, আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমি মালদ্বীপে বেড়াতে যাব। দেখা যাক, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় কি না। প্রিয় শ্রোতা, আপনারা আমার এবং আমার অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া করবেন।
তো, বলছিলাম মালদ্বীপের কথা। সেখানকার দ্বীপের সুন্দর দৃশ্য, সমুদ্রের
বাতাস, সমুদ্রের উপর নির্মিত বাড়িঘর আর নারিকেল গাছ সবই খুবই সুন্দর। ছবি
দেখে আর বর্ণনা শুনেই আমি এসবের ভক্ত হয়ে গেছি। আপনি ছুটি কাটাতে কোনো
সুন্দর জায়গার কথা ভাবছেন? আপনার ভাবনায় অবশ্যই স্থান পাবে মালদ্বীপ।
মালদ্বীপ তো স্রেফ একটি দ্বীপদেশ নয়, এ যেন স্বর্গ। শহরের ব্যস্ত জীবন ও
ধোয়াশার চেয়ে এখানকার সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেক আকর্ষণীয় বৈকি।
আলিম. হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। এ দেশ সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি বারো শতাধিক ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এসব দ্বীপের মধ্যে মাত্র ২০২টিতে মানুষ বাস করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেশটি শ্রীলংকা থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার, উত্তরাঞ্চলে ভারত থেকে ১১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেশটির মোট আয়তন মাত্র ৩০০ বর্গকিলোমিটার। বলা বাহুল্য, এটি এশিয়ার সবচে ছোট দেশ। বিশ্বের অনেক পর্যটক এ দেশকে দুনিয়ায় সবচে সুন্দর স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সুবর্ণা. ভারতীয় সমুদ্রের একটি দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে এখানকার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৮ মিটার। বিষুবরেখার কাছে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে মাত্র একটি ঋতু আছে। এদেশে সারা বছর গড় তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মালদ্বীপের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাচীনকালে মালদ্বীপ ছিল পর্যটকদের বিশ্রামস্থল। গ্রিসের ভূগোলবিদ টলেমি খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে তাঁর বইয়ে লিখেছেন: "শ্রীলংকার পশ্চিম দিকে ১৩৭৮টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি জায়গা আছে।" বস্তুত তখন থেকেই মালদ্বীপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে একটি দারুণ রহস্যময় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়। নবম শতাব্দীতে পার্সিয়ান ব্যবসায়ী সুলেইমান ভারতীয় সমুদ্র অতিক্রম করেছিলেন। তখন তিনি লিখেছিলেন: "১৯০০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশের মালিক একজন মহিলা; তাঁর সম্পত্তি অনেক বেশি।" চীনের পর্যটক জেং হোও মালদ্বীপে বেড়াতে এসেছিলেন। ১৪৩৩ সালে তিনি পূর্ব আফ্রিকায় যাত্রা করার পথে তাঁর ব্যবসায়ী জাহাজ মালদ্বীপে এসে দড়ি কিনেছিল। চীনের মিং রাজবংশ আমলে চীনারা এ দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে। তারা এ দ্বীপপুঞ্জকে 'পানির নিচে লুকিয়ে থাকা পাহাড়' হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং স্থানীয় অঞ্চলের রীতিনীতি ও আবহাওয়া সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করে।
আলিম. আচ্ছা, মালদ্বীপের কিছু তথ্য জানার পর এখন আমরা একটি গান শুনি। গানের শিরোনাম 'বিস্তীর্ণ সমুদ্র আর আকাশ'। গানটি গেয়েছে চীনের হংকং বিশেষ প্রশাসনিক এলাকার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ব্যান্ড দল 'বিয়ন্ড'। এ গানের সুর ও কথা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে চীনাদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় ছিল। চলুন একসঙ্গে গানটি শুনি।
সুবর্ণা. প্রিয় শ্রোতা, সুন্দর গানটি শোনার পর এখন মালদ্বীপ সম্পর্কে
আরো কিছু তথ্য জানাই। প্রাচীনকালে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা
অভিবাসীরা নানা ধরনের সংস্কৃতি নিয়ে এসেছে এখানে। এ কারণেই, স্থানীয়
অঞ্চলের সংগীত ও নৃত্যের র্সাথে পূর্ব আফ্রিকার সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া, দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য সংস্কৃতি মালদ্বীপের ওপর
গভীর প্রভাব ফেলেছে। এ দেশের মানুষ মূলত ইসলাম ধর্মাবলম্বী। দেশটির অধিকাংশ
নারী সমাজের বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়। সরকারি অফিস, সেনাবাহিনী ও পুলিশ
স্টেশনে অনেক মহিলা কর্মকর্তা দেখা যায়।
আলিম. সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য বিশ্বব্যাপী আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। এখানকার সমুদ্রের রঙ অতি পরিস্কার ও নীল এবং বালির রঙ সাদা। সমুদ্রের মধ্যে হাজার ধরনের মাছ দেখা যায়। মালদ্বীপে বেড়াতে এলে আপনি থাকতে পারেন সমুদ্রের পানির ওপর বিশেষভাবে নির্মিত বাড়িতে। এসব বাড়ি থেকে পর্যটকরা সমুদ্রের বিভিন্ন রঙের মাছ ও প্রাণি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান; শুনতে পান সামুদ্রিক পাখির ডাক। আর যদি আপনি সমুদ্র সৈকতে থাকতে চান, তাহলে আপনার জন্য আছে বিশেষভাবে নির্মিত বাড়ি। সাধারণত সমুদ্রের মধ্যে নির্মিত বাড়িগুলো সৈকত থেক ১০ মিটার দূরে অবস্থিত। কাঠের সেতু দিয়ে সেগুলোকে সৈকতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় কাঠের সেতুও থাকে না; পর্যটকরা ছোট নৌকায় করে সমুদ্রের বুকে নির্মিত বাড়িতে প্রবেশ করেন।
সুবর্ণা. মালদ্বীপের রাংগারি দ্বীপের একটি হোটেলের কর্তৃপক্ষ সমুদ্রের ৬ মিটার গভীরে স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে একটি রেস্তোরাঁ নির্মাণ করেছে। এ রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে মোট ১২ জন অতিথি বসতে পারেন। এ রেস্তোরাঁয় শুধু লাঞ্চ ও ডিনার পরিবেশন করা হয়। রেস্তোরাঁর নাম 'ithaa undersea restaurant'। স্থানীয় ভাষায় 'ইথা' অর্থ মুক্তা। রেস্তোরাঁর দেয়াল গ্লাস দিয়ে তৈরি। এটি সমুদ্রের গভীরে গ্লাস দিয়ে নির্মিত একমাত্র রেস্তোরাঁ। এটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। রেস্তোরাঁয় মোট ৬ টেবিল আছে। প্রতিটি টেবিলে মাত্র ২ জন অতিথি বসতে পারেন। অতিথিরা সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের নীচের মনোরম দৃশ্য দেখতে পারেন। নানা ধরনের রঙিন মাছ তাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। সে এক মজার অভিজ্ঞতা। তবে, এত সুন্দর পরিবেশে খাবার খাওয়ার মূল্যও কিন্তু বেশি। এখানে সবচে সস্তা লাঞ্চের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ২০০ মার্কিন ডলার।
আলিম. মালদ্বীপে পর্যটকদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থার অভাব নেই। বিশেষ করে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বিনোদন-প্রকল্প। পর্যটকরা এখানে সমুদ্রে ডাইভিং করতে পারেন; পারেন বিভিন্ন ধরনের নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে। মালদ্বীপের সবচে আকর্ষণীয় দৃশ্য দেখা যাবে কোরাল দ্বীপে। পর্যটকরা চাইলে সমুদ্রে মাছ ধরতে পারেন। আপনার মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নেই? নো প্রবলেম। আপনার জন্য সহজে মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে সেখানে। নিজে মাছ ধরুন এবং সেই মাছের রোস্ট দিয়ে ক্যান্ডেল ডিনার সারুন প্রিয় মানুষের সঙ্গে। যদি ডাইভিং করার আগ্রহ থাকে, তবে মালদ্বীপে যাওয়ার আগেই কিনে নিতে পারেন ডাইভিংয়ের কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী। কারণ, এ দেশে ডাইভিংয়ের প্রয়োজনীয় উপকরণ ভাড়া করতে আপনাকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে।
সুবর্ণা. মালদ্বীপের সূর্য দ্বীপে যেতে রাজধানী মালে থেকে নৌকায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে। এ দ্বীপে আছে মালদ্বীপের বৃহত্তম আরামদায়ক হোটেল। এর ইতিহাস অনেক পুরাতন। হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আপনি চাইলে নারিকেল গাছের নিচে শুয়ে সমুদ্রের ডাক শুনতে পারেন। আসলে হোটেলের কক্ষটিই তৈরি হয়েছে নারিকেল গাছের নীচে। ফলে আপনি নিজের ঘরে বসে উপভোগ করবেন সমুদ্রের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে সূর্যালোকে বসে বই পড়তে পারেন বা সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পারেন।
প্রতিবছর বড় দিন ও নববর্ষে হোটেলের ভাড়া অনেক বেড়ে যায়। তখন প্রতিদিন
আপনাকে কক্ষের ভাড়া বাবদ গুনতে হবে কমপক্ষে ৫০০ মার্কিন ডলার। ইউরোপ ও
আমেরিকার অনেক পর্যটক এখানে এসে নববর্ষ বা বড় দিন উদযাপন করেন। এখানে বসে
যেন স্বর্গের সুখ আর আনন্দ উপভোগ করা যায়। এ দ্বীপের হোটেলে অনেক ধরনের
খাবার পাওয়া যায়। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বলে আপনি এখানে শুকরের মাংস পাবেন
না। তবে পাবেন মাছ, মুরগী ও গরুর মাংস দিয়ে তৈরী নানা ধরনের সুস্বাদু ডিশ
এবং বহু ধরনের মিষ্টি। এখানে বেড়াতে এলে আপনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের
খাবার চেখে দেখার সুযোগ পাবেন।
আলিম. আচ্ছা, প্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়। আজকের অনুষ্ঠানও শেষ
করতে হবে। আশা করি মালদ্বীপের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা শুনে আপনিও
সেখানে বেড়াতে যাবার সিদ্ধান্ত মনে মনে নিয়ে ফেলেছেন। মালদ্বীপ বাংলাদেশের
প্রতিবেশী দেশ। সুতরাং বাংলাদেশ থেকে সেখানে বেড়াতে যাওয়া খুব কঠিন কাজ নয়।
ভারত থেকেও মালদ্বীপে যাওয়া-আসা খুব সহজ। আশা করি সুযোগ পেলে আপনিও
সেখানে বেড়াতে যাবেন এবং দেখে আসবেন পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর প্রাকৃতিক
দৃশ্য। তাহলে, আজকের মতো এখানেই বিদায়। আগামী সপ্তাহে একই সময় আবার কথা
হবে। সবাই ভালো থাকুন, সুন্দর থাকুন, আর চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা
অনুষ্ঠানের সাথেই থাকুন। যাইচিয়ান।(সুবর্ণা/আলিম)
আলিম. নতুন বছরে কোথায় কোথায় বেড়ানো যায়, তা নিয়ে পর্যটকরা নিশ্চয়ই মাথা ঘামাচ্ছেন। গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকেও ভ্রমণ চীনাদের কাছে তেমন একটা জনপ্রিয় ছিল না। অনেক চীনা এ ব্যাপারে এক্কেবারেই সচেতন ছিলেন না। আশির দশকে এসে অনেক চীনার মনে ভ্রমণ বিষয়টি স্থান পায়। তখন অবশ্য বেশিরভাগ চীনাই ভ্রমণ বলতে বুঝতেন কাজের খাতিরে বাসা থেকে কয়েক দিনের জন্য বাইরে থাকাকে। নব্বইয়ের দশকে চীনাদের জন্য তিব্বতের লাসা শহরে বেড়াতে যাওয়া একটি দারুণ মজার ব্যাপার ছিল। কিন্তু একুশ শতকে এসে প্রায় সকল চীনার জীবনে ভ্রমণ একটি প্রয়োজনীয় অংশে পরিণত হয়েছে। 'রাস্তায় আছি' এবং 'লাগেজ নিয়ে যে কোনো স্থানে বেড়াতে যাওয়া' শব্দগুচ্ছ এখন চীনাদের কাছে খুবই পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত।
সে যাক, গত কয়েক দশক ধরে ভ্রমণ সম্পর্কে মানুষের চিন্তাধারা অনেক উন্নত হয়েছে। মানুষ এখন স্রেফ বিনোদনের জন্য ভ্রমণ করে না, জীবনকে সমৃদ্ধ করতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থান ও জাতি সম্পর্কে জানার পরিধিকে বিস্তৃত করতেও ভ্রমণ করে। প্রিয় শ্রোতা, বিশ্বে অনেক সুন্দর দর্শনীয় স্থান আছে, আপনারা সেটা জানেন। গত বছরের মতো এ বছরেও আমরা আপনাদের নিয়ে যাব সুন্দর সুন্দর সব পর্যটন স্থানে; আর ঘুরে বেড়াবো মনের আনন্দে। আজ চলুন বেড়িয়ে আসি বিশ্বের অন্যতম সুন্দর দ্বীপ মালদ্বীপে।
সুবর্ণা. মালদ্বীপ আমার কাছে একটি দারুণ সুন্দর ও মজার পর্যটন স্থান। এক সময় আমার একটি পরিকল্পনা ছিল। পরিকল্পনাটি হচ্ছে: দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ দেশেই হবে আমার হানিমুন। কিন্তু মানুষের সব পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ দেওয়া যায় না। সময় ও পরিস্থিতির কারণে, মালদ্বীপে আমার হানিমুন হয়নি। এখন ভাবছি, আমার অনাগত সন্তানকে নিয়ে আমি মালদ্বীপে বেড়াতে যাব। দেখা যাক, এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় কি না। প্রিয় শ্রোতা, আপনারা আমার এবং আমার অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া করবেন।

আলিম. হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। এ দেশ সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি বারো শতাধিক ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত। এসব দ্বীপের মধ্যে মাত্র ২০২টিতে মানুষ বাস করে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে দেশটি শ্রীলংকা থেকে ৬৭৫ কিলোমিটার, উত্তরাঞ্চলে ভারত থেকে ১১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দেশটির মোট আয়তন মাত্র ৩০০ বর্গকিলোমিটার। বলা বাহুল্য, এটি এশিয়ার সবচে ছোট দেশ। বিশ্বের অনেক পর্যটক এ দেশকে দুনিয়ায় সবচে সুন্দর স্বর্গ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সুবর্ণা. ভারতীয় সমুদ্রের একটি দ্বীপপুঞ্জ হিসেবে এখানকার উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.৮ মিটার। বিষুবরেখার কাছে অবস্থিত হওয়ার কারণে এখানে মাত্র একটি ঋতু আছে। এদেশে সারা বছর গড় তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মালদ্বীপের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাচীনকালে মালদ্বীপ ছিল পর্যটকদের বিশ্রামস্থল। গ্রিসের ভূগোলবিদ টলেমি খ্রিষ্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে তাঁর বইয়ে লিখেছেন: "শ্রীলংকার পশ্চিম দিকে ১৩৭৮টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি জায়গা আছে।" বস্তুত তখন থেকেই মালদ্বীপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের কাছে একটি দারুণ রহস্যময় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়। নবম শতাব্দীতে পার্সিয়ান ব্যবসায়ী সুলেইমান ভারতীয় সমুদ্র অতিক্রম করেছিলেন। তখন তিনি লিখেছিলেন: "১৯০০টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত দেশের মালিক একজন মহিলা; তাঁর সম্পত্তি অনেক বেশি।" চীনের পর্যটক জেং হোও মালদ্বীপে বেড়াতে এসেছিলেন। ১৪৩৩ সালে তিনি পূর্ব আফ্রিকায় যাত্রা করার পথে তাঁর ব্যবসায়ী জাহাজ মালদ্বীপে এসে দড়ি কিনেছিল। চীনের মিং রাজবংশ আমলে চীনারা এ দ্বীপপুঞ্জ সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে। তারা এ দ্বীপপুঞ্জকে 'পানির নিচে লুকিয়ে থাকা পাহাড়' হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং স্থানীয় অঞ্চলের রীতিনীতি ও আবহাওয়া সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য লিপিবদ্ধ করে।
আলিম. আচ্ছা, মালদ্বীপের কিছু তথ্য জানার পর এখন আমরা একটি গান শুনি। গানের শিরোনাম 'বিস্তীর্ণ সমুদ্র আর আকাশ'। গানটি গেয়েছে চীনের হংকং বিশেষ প্রশাসনিক এলাকার বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ব্যান্ড দল 'বিয়ন্ড'। এ গানের সুর ও কথা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে চীনাদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় ছিল। চলুন একসঙ্গে গানটি শুনি।

আলিম. সার্কভুক্ত দেশ মালদ্বীপের সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য বিশ্বব্যাপী আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয়। এখানকার সমুদ্রের রঙ অতি পরিস্কার ও নীল এবং বালির রঙ সাদা। সমুদ্রের মধ্যে হাজার ধরনের মাছ দেখা যায়। মালদ্বীপে বেড়াতে এলে আপনি থাকতে পারেন সমুদ্রের পানির ওপর বিশেষভাবে নির্মিত বাড়িতে। এসব বাড়ি থেকে পর্যটকরা সমুদ্রের বিভিন্ন রঙের মাছ ও প্রাণি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান; শুনতে পান সামুদ্রিক পাখির ডাক। আর যদি আপনি সমুদ্র সৈকতে থাকতে চান, তাহলে আপনার জন্য আছে বিশেষভাবে নির্মিত বাড়ি। সাধারণত সমুদ্রের মধ্যে নির্মিত বাড়িগুলো সৈকত থেক ১০ মিটার দূরে অবস্থিত। কাঠের সেতু দিয়ে সেগুলোকে সৈকতের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। কিছু কিছু জায়গায় কাঠের সেতুও থাকে না; পর্যটকরা ছোট নৌকায় করে সমুদ্রের বুকে নির্মিত বাড়িতে প্রবেশ করেন।
সুবর্ণা. মালদ্বীপের রাংগারি দ্বীপের একটি হোটেলের কর্তৃপক্ষ সমুদ্রের ৬ মিটার গভীরে স্বচ্ছ গ্লাস দিয়ে একটি রেস্তোরাঁ নির্মাণ করেছে। এ রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে মোট ১২ জন অতিথি বসতে পারেন। এ রেস্তোরাঁয় শুধু লাঞ্চ ও ডিনার পরিবেশন করা হয়। রেস্তোরাঁর নাম 'ithaa undersea restaurant'। স্থানীয় ভাষায় 'ইথা' অর্থ মুক্তা। রেস্তোরাঁর দেয়াল গ্লাস দিয়ে তৈরি। এটি সমুদ্রের গভীরে গ্লাস দিয়ে নির্মিত একমাত্র রেস্তোরাঁ। এটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। রেস্তোরাঁয় মোট ৬ টেবিল আছে। প্রতিটি টেবিলে মাত্র ২ জন অতিথি বসতে পারেন। অতিথিরা সুস্বাদু খাবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের নীচের মনোরম দৃশ্য দেখতে পারেন। নানা ধরনের রঙিন মাছ তাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। সে এক মজার অভিজ্ঞতা। তবে, এত সুন্দর পরিবেশে খাবার খাওয়ার মূল্যও কিন্তু বেশি। এখানে সবচে সস্তা লাঞ্চের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ২০০ মার্কিন ডলার।
আলিম. মালদ্বীপে পর্যটকদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থার অভাব নেই। বিশেষ করে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন বিনোদন-প্রকল্প। পর্যটকরা এখানে সমুদ্রে ডাইভিং করতে পারেন; পারেন বিভিন্ন ধরনের নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে। মালদ্বীপের সবচে আকর্ষণীয় দৃশ্য দেখা যাবে কোরাল দ্বীপে। পর্যটকরা চাইলে সমুদ্রে মাছ ধরতে পারেন। আপনার মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নেই? নো প্রবলেম। আপনার জন্য সহজে মাছ ধরার ব্যবস্থা আছে সেখানে। নিজে মাছ ধরুন এবং সেই মাছের রোস্ট দিয়ে ক্যান্ডেল ডিনার সারুন প্রিয় মানুষের সঙ্গে। যদি ডাইভিং করার আগ্রহ থাকে, তবে মালদ্বীপে যাওয়ার আগেই কিনে নিতে পারেন ডাইভিংয়ের কিছু প্রয়োজনীয় সামগ্রী। কারণ, এ দেশে ডাইভিংয়ের প্রয়োজনীয় উপকরণ ভাড়া করতে আপনাকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হবে।
সুবর্ণা. মালদ্বীপের সূর্য দ্বীপে যেতে রাজধানী মালে থেকে নৌকায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে। এ দ্বীপে আছে মালদ্বীপের বৃহত্তম আরামদায়ক হোটেল। এর ইতিহাস অনেক পুরাতন। হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আপনি চাইলে নারিকেল গাছের নিচে শুয়ে সমুদ্রের ডাক শুনতে পারেন। আসলে হোটেলের কক্ষটিই তৈরি হয়েছে নারিকেল গাছের নীচে। ফলে আপনি নিজের ঘরে বসে উপভোগ করবেন সমুদ্রের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য। আপনি ঘর থেকে বের হয়ে সূর্যালোকে বসে বই পড়তে পারেন বা সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পারেন।


কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন